মীর আব্দুল হালিম
“করোনা ভাইরাস (কতিপয় বিধান শিথিলকরণ) অধ্যাদেশ ২০২০” নামে একটি “বিশেষ আইন” জারি করা হলে বহু আইনি জটিলতা থেকে বেঁচে যেতে পারে বাংলাদেশ। কোর্ট কাচারিও বেঁচে যাবে বহু মামলাজট থেকে, আইনের আশ্রয়ে সচল থাকবে অর্থনীতির চাকা। জয় হবে আইন ও অর্থনীতির। মানবিক বিপর্যয় থেকে সমাজকে রক্ষা করার প্রয়োজনে এ ধরনের আইন প্রণয়নের বিকল্প নাই। ইউরোপীয় এবং দক্ষিণ এশীয় দেশসমূহের আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ প্রমাণ করে এ ধরনের প্রয়োজনীয়তা আমাদের এখানেও বিদ্যমান। বিভিন্ন দপ্তরের বিধিবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত বিধি-বিধান প্রতিপালন করা সম্ভব হচ্ছে না তাই আইনি ঘোষণার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে আইনি বিপর্যয় আসন্ন।
নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আইনি জটিলতা নিরসনে সবচেয়ে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে যুক্তরাজ্য। প্রতিবেশী দেশ ভারতের ভূমিকা এক্ষেত্রে অত্যন্ত যুগোপযোগী এবং উল্লেখযোগ্য এমনকি পাকিস্তানও তাই। কিন্তু বাংলাদেশে সে তুলনায় ঘুমিয়ে আছে। এসব নিয়ে ভাবার কেউ নাই। সরকারি অফিস আদালত বন্ধ, সংসদ বন্ধ, কোর্ট কাচারি বন্ধ, আইন চর্চা ও বন্ধ। করোনা ভাইরাসের কারণে বহু আইনি সমস্যার জন্ম হচ্ছে যেগুলি অচিরেই আদালতের ঘাড়ে বোঝা হিসেবে আসবে। তাই দ্রুত অগ্রিম পদক্ষেপ নিতে পারলে বহু আইনি জটিলতার সমাধান সহজে করা সম্ভব। করোনা ভাইরাসের মতোই অদৃশ্য শক্তির ভয়ে কেউ যেন মুখ খোলে না অথচ তাহাদের কেশ এর নিচে বহু প্রতিভা লুকিয়ে আছে, আছে সক্ষমতাও এ ধরনের আইন প্রণয়ন করার। দয়া করে জননেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ বিষয়গুলো সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করুন যাতে উনার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়, এদেশের সবকিছুই যে বিরোধীদলীয় ষড়যন্ত্র নয় এটাও ব্যাখ্যা করুন, কোন প্রকার তৈল ছাড়াই। আমার বিশ্বাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে ইচ্ছুক হবেন।
ভারতের আইনি পদক্ষেপ: সারসংক্ষেপ
১. করোনা ভাইরাস মহামারী দেখা দেয়ার সাথে সাথে ভারত দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার “দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০০৫” এর অধীনে সারাদেশে “লকডাউন” ঘোষণা করেছে যা দ্বিতীয় দফায় বাড়িয়ে তা ১৭ মে পর্যন্ত বলবৎ রাখা হয়েছে। শ্রম মন্ত্রণালয় মালিকদের প্রতি লিখিত অনুরোধ করেছেন যে এই সময়ে যেন কোনো শ্রমিককে ছাঁটাই বা টার্মিনেট না করা হয়। লকডাউন ঘোষণার কারণে করুনা কালে কর্মস্থলে শ্রমিক-কর্মচারীর অনুপস্থিতিকে কর্মসময় বলে বিবেচনা করার অনুরোধ করেছেন। সাথে তাদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার।
২. করোনা মহামারীতে স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরাই সম্মুখ যুদ্ধা এবং তাদের সুরক্ষার জন্য ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি “মহামারী রোগ (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২০” জারি করার সম্মতি প্রদান করেছেন। মহামারী চলাকালে স্বাস্থ্য সেবা কর্মীদের জীবন, বাসস্থান, সম্পত্তি ও কর্মস্থল ইত্যাদিকে সম্ভাব্য সহিংসতা (হয়রানি/শারীরিক আঘাত/সম্পত্তির ক্ষতি সাধন) থেকে রক্ষা করার জন্য এই অধ্যাদেশ। স্বাস্থ্য সেবা কর্মীদের উপর কোন আঘাত অথবা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোন সম্পত্তিতে যেকোনো ধরনের সহিংসতাকে আদালত কর্তৃক আমলযোগ্য (cognizable)ও জামিন অযোগ্য (non bailable) অপরাধ হিসেবে বর্ণনার পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে। স্বাস্থ্য সেবার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা সম্পত্তির প্রতি কোন ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতিতে (zero tolerance) স্বাস্থ্যসেবাকে নির্বিঘ্ন রাখার স্বার্থে এ ধরনের অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। সহিংসতার অপরাধ প্রমাণে তিন মাস থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার থেকে ২ লক্ষ রুপি পর্যন্ত জরিমানা, গুরুতর আহত হওয়ার ক্ষেত্রে ৬ মাস থেকে ৭ বছর মেয়াদে কারাদণ্ড এবং ১ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ রুপি জরিমানার বিধান অধিকন্তু ক্ষতিগ্রস্তকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সম্পত্তির ন্যায্য বাজার মূল্যের দ্বিগুণ প্রদান করতে বাধ্য থাকবে।
৩. করোনা মহামারীতে রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমিয়ে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি “মন্ত্রীদের বেতন ও ভাতা (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০২০” জারি করেছেন। এর মাধ্যমে পহেলা এপ্রিল ২০২০ থেকে আগামী এক বছর মন্ত্রীদের সুযোগ-সুবিধা ৩০ শতাংশ হারে কমানো হয়েছে।
৪. জরুরি অবস্থা মেটাতে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি “সংসদ সদস্যদের বেতন, ভাতা ও পেনশন (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০২০” জারি করেছেন। এর মাধ্যমে পহেলা এপ্রিল ২০২০ থেকে আগামী এক বছর সংসদ সদস্যদের সুযোগ সুবিধাও ৩০ শতাংশ হারে কমানো হয়েছে।
৫. কর ব্যবস্থা ও সার্বিক বিষয়াদি সহজ করার জন্য ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি “করারোপন এবং অন্যান্য আইন (কতিপয় বিধান শিথিলকরণ) অধ্যাদেশ ২০২০” জারি করেছেন। মহামারীতে জনজীবনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে সকল প্রকার কর এবং অন্যান্য আইনে বিশেষ করে সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে এবং অন্যান্য কিছু বিধান শিথিল করা হয়েছে। আয়কর দাখিল করার সময়সীমা জরিমানা ছাড়াই বাড়ানো হয়েছে এবং নানা ক্ষেত্রে প্রতি পালনীয় বিষয় কে শিথিল করা হয়েছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে একটি বিশেষ তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে যেখানে অনুদান প্রদান কে আয়কর ছাড়ের আওতায় আনা হয়েছে।
পাকিস্তানের আইনি পদক্ষেপ: সারসংক্ষেপ
পাকিস্তান মহামারীর কারণে সৃষ্ট জটিলতা সমূহ নিরসনে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। “মহামারী রোগ সংক্রান্ত আইন ২০১৪” এর আওতায় সিন্ধু প্রদেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। নির্দেশনা জারি করা হয়েছে যে লকডাউন চলাকালীন কোন শ্রমিককে লে অফ বা ছাঁটাই করা যাবে না, এসময়ে পুর্ণ মজুরি দিতে হবে, বন্ধকালীন সময় কে মজুরিসহ ছুটি বলে গণ্য করতে হবে। বিনিময়ে শিল্পমালিকরা সরকারি প্রণোদনা পাবেন।
যুক্তরাজ্যের আইনি পদক্ষেপ: সারসংক্ষেপ
সম্প্রতি ২৫ মার্চ ২০২০ তারিখে যুক্তরাজ্যের আইনসভা “করোনা ভাইরাস আইন ২০২০” পাশ করেছে । আইনটি সরকারকে বিশেষ নির্বাহি ক্ষমতা প্রদান করেছে যাতে করে সে মহামারীর কারণে সৃষ্ট আইনি জটিলতায় মানবাধিকার রক্ষা করে নানারকম শিথিলতা ও নিয়ন্ত্রণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সরকারকে বিশেষ ক্ষমতা চর্চার বৈধতা প্রদান করে ৩৫৯ পৃষ্ঠার এ আইনে ১০২ টি ধারা ২৯ টি সিডিউল রয়েছে যার মধ্যে ৮৯ ধারাটি সূর্যাস্ত নীতি (Sunset Rule) প্রদান করে। এ নীতি অনুসারে আগামী দুই বছর পর সূর্যাস্তের সাথে সাথে আইনটি রহিত হয়ে যাবে তবে সংসদ চাইলে বিশেষ অবস্থায় ৬ মাস কম বা বেশি করতে পারে। আগ্রহী ব্যক্তিগণ এই লিংকে আইনটির কপি দেখতে পারেন। (http://www.legislation.gov.uk/ukpga/2020/7/contents)
এই আইনটি জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা, সমাজসেবা,, গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় দপ্তর, স্বাস্থ্য সেবায় মেডিকেল শিক্ষার্থী এবং অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের তালিকাভুক্তকরণ, দাফন-কাফন এবং আদালতসহ প্রয়োজনীয় সরকারি সেবা গুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ওপর দায়িত্বভার শিথিলকরণ ও প্রয়োজনীয় প্রণোদনা প্রণয়ন এবং পাশাপাশি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে মালিক ও কর্মচারীদের সহায়তার জন্য সাময়িক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
এই আইনে মহামারী কালীন অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব মোকাবেলার ব্যবস্থাও দেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য হলো ভাড়াটিয়াদের উচ্ছেদের কাজ বন্ধ করা (বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভাড়াটিয়াদের কে তিন মাসের জন্য নোটিশ প্রদান থেকে বিরত থাকা), জরুরী স্বেচ্ছাসেবীদের বেকার হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা এবং অতিরিক্ত কর্তব্য পালনের কারণে স্বাস্থ্য সেবা কর্মীদের জন্য বিশেষ বীমা কভারেজ সরবরাহ করা।
করোনা ভাইরাস দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কর্মচারীদেরকে অসুস্থতা ছুটির আওতায় নিয়োগদাতার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে এবং সুপারমার্কেট চেইন সমূহের ঘটনা, খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি কিংবা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিষয়ে সরকারকে নিয়মিত রিপোর্ট করবে।কর্মচারীরা তিনদিনের নোটিশ দিয়ে জাতীয় স্বেচ্ছাসেবায় অংশগ্রহণ করতে পারবে যার কারণে তার বর্তমান চাকরি ব্যাহত হবে না।
এই করোনা ভাইরাস আইনের আওতায় ই-জুডিশিয়ারি চালু করার ব্যবস্থা দিয়েছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় উক্ত আইনের ই-জুডিশিয়ারি বা ডিজিটাল ফাইলিং ও শুনানী চালু করার বিষয়ে দিকনির্দেশনা রয়েছে। আইনটি বিদ্যমান কার্যপদ্ধতি সংশোধন করে টেলিফোন বা ভিডিও কনফারেন্সিং সুবিধাগুলি ব্যবহার করে শুনানিতে অংশ নেওয়া সহ সংশ্লিষ্ট পক্ষের শারীরিকভাবে আদালতে উপস্থিতির প্রয়োজন ছাড়াই অডিও/ভিডিও শুনানি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। যুক্তরাজ্য আদালত চলমান রাখার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই এ ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনি পদক্ষেপ: সারসংক্ষেপ
করোনা ভাইরাসের কারণে যুক্তরাষ্ট্র অনেকগুলো আইন এবং আদেশ জারি করেছে। করোনা ভাইরাস প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া পরিপূরক বরাদ্দ আইন ২০২০, করোনা ভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সুরক্ষা আইন ২০২০, করোনা ভাইরাস সহায়তা, ত্রাণ এবং অর্থনৈতিক সুরক্ষা আইন ২০২০। এছাড়াও টিকা আবিষ্কারের জন্য প্রাথমিক অর্থায়ন ও সহায়তা করেছে, অসুস্থ, ছুটি বেকারত্ব রোধে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। আয়কর প্রদান ও দাখিলের সময়সীমাও বাড়ানো হয়েছে। নাগরিকদের মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য এত সব ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে যা স্বল্পপরিসরে আলোচনা করা মুশকিল বটে!
বাংলাদেশে সাংবিধানিক সংকট হয়েছে কি?
বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সাধারণ ছুটি ও সীমিত আকারে লক ডাউন ঘোষণা করেছে যা আগামী 1৫ মে ২০২০ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে এবং সমস্ত গণপরিবহন স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৮ এর অধীনে সারাদেশকে করোনা ভাইরাস এর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে, এমনকি জনগণের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে বিশেষ করে সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ভোর ৬ টা পর্যন্ত যেকোনো ধরনের চলাচল নিষিদ্ধ। আইন অমান্য করলে মোবাইল কোর্ট এর আওতায় জেল ও জরিমানা গুণতে হবে এবং বাস্তবে গুনতেও হচ্ছে । সুপ্রিম কোর্ট সহ নিম্ন আদালত সমূহ বন্ধ থাকায় বিচার প্রার্থীদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে জামিন প্রার্থীদের ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে এক জটিলতা। এই জটিলতাকে অনেকেই সাংবিধানিক সঙ্কট হিসেবে দেখছেন এবং অনেকেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা বা সংবিধান স্থগিত করার কথাও বলেছেন। আবার অনেকে “দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২” সংশোধনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও বৈধতা নেওয়ার কথা বলেছেন। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পে। এ দুর্যোগকালীন সময়ে শ্রম মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশনা না থাকায় হাজার হাজার শ্রমিক তাদের জীবিকা ও চাকরি নিয়ে অসহায় জীবন যাপন করছে। হাজারেরও অধিক কারখানা লে অফ ঘোষণা করা হয়েছে, অনেক শ্রমিক তাদের চাকরি হারিয়েছে যার ফলে সামাজিক বিপর্যয় আসন্ন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক বিষয়ে মহামারীর প্রতিক্রিয়া সামলানোর জন্য কিছু প্রণোদনা ও নির্দেশনা জারি করেছে। এসব নির্দেশনায় সমন্বয় করন এবং সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার অভাবে বিশেষ মহল সুযোগ নিতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন।
আমি মনে করি এটা সাংবিধানিক সংকট নয়। বর্তমান প্রচলিত আইন দ্বারা এ সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব নয় যেহেতু এই সংকট মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল এবং এ সম্পর্কে পূর্বানুমান করা অসম্ভব ছিল। তাই “করোনা ভাইরাস (কতিপয় বিধান শিথিলকরণ) অধ্যাদেশ ২০২০” নামে একটি “বিশেষ আইন” জারি করা হলে এ সংকট মোকাবেলা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করতে আইন সংশোধন আবশ্যক
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সহ দেশব্যাপী অবস্থিত নিম্ন আদালত সমূহে ভার্চুয়াল কোর্ট, ই-কোর্ট, অনলাইন শুনানি, অনলাইন ফাইলিং, পক্ষসমূহের আদালতে অনুপস্থিতির গ্রহণযোগ্যতা, ইমেইল কমিউনিকেশনকে পোস্টাল নীতি হিসেবে গ্রহণ করা ইত্যাদি বিষয় সহ ডিজিটাল কোর্ট চালু করতে হলে বিদ্যমান কার্যপদ্ধতি ও সাক্ষ্য আইনের সংশ্লিষ্ট কিছু ধারা সংশোধন করতে হবে। এসব আইন ও বিধি সংশোধন ছাড়া ডিজিটাল কোর্ট চালু করা হলে তা পদ্ধতিগত আইনের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন থেকেই যাবে। পাশাপাশি নবীন ও প্রবীণ আইনজীবী, বিচারক এবং আদালত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডিজিটাল সাক্ষরতা ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো বিবেচনার বিষয়। করোনার সময়ে যেখানে চলাচল সীমাবদ্ধ সেখানে এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় এই অচলাবস্থা একটি আইনি শংকট যাকে অনেকেই সাংবিধানিক সংকটের সাথে তুলনা করছেন, অনেকেই ডিজিটাল কোর্ট চালুর মাধ্যমে মানুষের বিচারের অধিকার নিশ্চিত করার পক্ষে মতামত দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাজ্যের আইন থেকে দিক নির্দেশনা নিতে পারে এবং বাংলাদেশের জন্য উপযোগী করে প্রয়োজনে সংক্ষিপ্ত করে আইন প্রণয়ন করতে পারে। সংসদের অধিবেশন না বসতে পারলেও সংবিধানে প্রদত্ত বিকল্প ব্যবস্থা বা রাষ্ট্রপতির অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে এ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ সরকার করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সাধারণ ব্যবস্থাপনায় যেমন কৃতিত্ব দেখাচ্ছে তেমনি একটি নতুন আইন প্রণয়ন করলে এ সংকট বিচার বিভাগেও কেটে যাবে এবং আদালত ব্যবস্থাপনায় কোন সংকট থাকবে না। আমাদের সরকারে বিজ্ঞ আইনজ্ঞরা রয়েছেন, রয়েছেন আইনপ্রণেতারাও, তারাও অন্যান্য সরকারের কার্যক্রমে অনুপ্রাণিত হয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারে।
বাংলাদেশ সরকারকে লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতি, গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করন, সরকারি ও বেসরকারি অফিস এবং শিল্প-কারখানা ইত্যাদি বন্ধের জন্য ব্যাপক ক্ষমতা সম্পন্ন আইনি ভিত্তি দরকার। মহামারী নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নির্বাহী ক্ষমতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঙালির দ্বৈত চরিত্রের কথা বিবেচনা করে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা রাখার পক্ষে ও বিশেষজ্ঞরা মত প্রদান করেছেন।
এসব অবস্থা মোকাবেলায় একটি নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ই-জুডিশিয়ারি বাস্তবায়ন সহ অন্যান্য বিষয়ে সামগ্রিক দিক নির্দেশনা থাকতে পারে যা জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে সম্ভব নয়। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে স্বাক্ষরিত চুক্তি সমূহ ফোর্স মেজার বা দৈব শক্তির কারণে চুক্তি পালন করা অসম্ভব হতে পারে এবং সেসব ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে নতুবা অদূর ভবিষ্যতে চুক্তিভঙ্গ সংক্রান্ত হাজারো মামলা আদালতে গড়াবে।
অধ্যাদেশ ড্রাফটিং খুবই জটিল বিষয়?
আমার মনে হয় সরকারি ও বেসরকারি বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে একটি বিশেষ দল গঠন করলে দ্রুত এরকম একটি আইনের ড্রাফট করা যেতে পারে। আমার মনে হয় আমাদের বিজ্ঞ আইনজীবী সমাজ, বিজ্ঞ বিচারক বৃন্দ, এবং আইন প্রণেতাগণ এর মধ্য থেকে আইনে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ এদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ দল আগামী ১০ দিন এ ব্যাপারে আন্তরিকতার সাথে কাজ করলে একটি বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করা সম্ভব। এ বেলায় আইনজীবীদের ডাক পড়লে কোন প্রকার বিনিময় ছাড়াই দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে তারা প্রস্তুত থাকবে বলে মনে করি। এই অধ্যাদেশে করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট লকডাউন জটিলতার সার্বিক বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে এবং সুস্পষ্ট বিধান প্রণয়নের মাধ্যমেই অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখা সম্ভব হতে পারে, অবহেলায় আইনি দুর্যোগ আসন্ন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরোক্ত বক্তব্য একটি আইনি বিশ্লেষন, শিক্ষামূলক ও লেখক এর ব্যক্তিগত অভিমত।
লেখক: মীর আব্দুল হালিম, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং সমন্বয়ক, বাংলাদেশ লিগ্যাল-টেক সোসাইটি।
ইমেইল: bnm.mir@gmail.com