এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
আপনার সম্পত্তি যদি কেউ জোর করে দখল করে নেয়, জবর দখল করে রাখে, সম্পূর্ণ অবৈধভাবে আপনাকে স্থাবর সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ করে, তাহলে আপনি কি করবেন, কিভাবে দখলদারীদের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই লড়ে সম্পত্তি পূণরুদ্ধার করবেন, এর জন্য কি মামলা, কেন, কখন, কিভাবে, কত সময়ের মধ্যে করতে হবে, কত টাকা খরচ হবে-অর্থাৎ উচ্ছেদ মামলার সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা পড়ুন।
আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭ এর ধারা ৯ এ বলা আছে- ‘স্থাবর সম্পত্তি হতে যদি কেউ অন্যায়ভাবে দখলচ্যূত হন, তাহলে তিনি অথবা তার মাধ্যমে দাবিদার কোন ব্যক্তি মামলার মাধ্যমে তার দখল পুনরুদ্ধার করতে পারে। ১৯০৮ সালের তামাদি আইনের সিডিউল ১৪২ এ বলা আছে দখল পূণরুদ্ধারের মামলা দখলচ্যুতির কতদিনের মধ্যে করতে হবে। অন্যদিকে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ১৪৫ উপধারা ৬ এ বলা আছে, আইনসঙ্গতভাবে উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত দখলে থাকা পক্ষ দখল বহাল রাখিবে।
‘দখল সব সময় বৈধ সত্বকে অনুসরন করে। ইহা সর্বজনবিদিত যে, প্রকৃত মালিকের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধ দখল হয় না। বৈরি দখল-এর মাধ্যমে উহা প্রয়োগ করা হয়। একভাবে দখল করিলেই আইন বিরুদ্ধ দখল সুষ্টি হয় না। (৩৮ ডিএলআর (এডি) ২২)।
অন্যত্র বলা আছে- ‘আসল বা প্রকৃত মালিকের যদি বৈধ সত্ত¡াধিকারের অস্তিত্ব থাকে, তবে দখল করিলেই বিরুদ্ধ দখল সৃষ্টি হয় না ২০ বিএলডি (হাইকোট) ৪০৭।’
উচ্চ আদালতের এই সকল সিদ্ধান্ত থেকে সহজেই বুঝা যায়, জবর দখল স্বীকৃত কোন পন্থা হতে পারে না, সেটা ১২ কেন ১০০ বছর হলেও। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়ে উঠবে। বৈধ দলিল ছাড়া শুধুমাত্র ১২ বছর বা ২০ বছর দখলে থাকলে রহিমের সম্পত্তির মালিক করিম হয়ে যাবে। এটা কোন আইন হতে পারে না। রফিক মিয়া তার সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে ২০০০ সালে একটি সম্পত্তি ক্রয় করেন। এরপর ২০১০ সালে ক্রয়কৃত জমির খাজনা পরিশোধ করতে ভূমি অফিসে গিয়ে জানতে পারেন- জরিপ কর্মকর্তাদের গাফিলাতির কারনে তার ক্রয়কৃত সম্পত্তির বিএস দাগ ভুলক্রমে একটি সরকারী সংস্থার নামে রেকর্ড হয়ে আছে। ভূমি অফিস থেকে বলা হয়- ‘বিএস রেকর্ড এর ভুলজনিত ত্রæটি সংশোধন করতে হলে কোর্টে মামলা দায়ের করতে হবে। এই ত্রæটি সংশোধন বিষয়ে রফিক মিয়া ঐ সরকারী সংস্থার অফিসে আলোচনা করতে গেলে সংস্থা থেকে বলা হয়, ‘সংস্থা যেহেতু আপনার ক্রয়কৃত জমির দাগটি একওয়ার অর্থাৎ অধিগ্রহণ করে নাই, সুতারং আপনি মামলা করেন আমরা কনটেষ্ট করবো না। আপনি একতরফা রায় পেয়ে যাবেন।’ এমন আশ্বাসের প্রেক্ষিতে জনাব রফিক মিয়া বাদী হয়ে বিএস সংশোধনী মামলা দায়ের করেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই মামলা অদ্যবধি কোর্টে চলমান আছে। কারন ঐ সংস্থার ঐ সময়ের প্রশাসন বার বার পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার কারনে অসাধু কর্মকর্তাদের কূট-কৌশল এবং দূর্নীতির কারনে ঐ মামলা নিষ্পত্তি হয় নাই। এরকম হাজারো সমস্যা নিয়ে মানুষ আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে।
আপনাদেরকে আরেকটি বিষয় জানিয়ে রাখি, জমি থেকে বেদখল হলে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য ফৌজদারি ও দেওয়ানি দুই আদালতে মামলা করা যায়। কোনো ব্যক্তি তাঁর সম্পত্তি থেকে বেদখল হওয়ার দুই মাসের মধ্যে তিনি ওই ব্যক্তিকে বেদখল করার চেষ্টা থেকে বিরত করার জন্য বা সম্পত্তিতে ওই দখলকারী ব্যক্তির প্রবেশ বারিত করে আদেশ প্রদানের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ অথবা ১৪৫ ধারার বিধান অনুসারে মামলা করতে পারবেন। এ ধরনের মামলা অল্প সময়ের মধ্যেই নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। মামলা দায়ের হলে ম্যাজিস্ট্রেট অপর পক্ষের ওপর সমন জারি করবেন। উভয় পক্ষের বক্তব্য এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে সম্পত্তির দখলদার নির্ণয় করবেন। পুলিশের মাধ্যমে সরেজমিনে তদন্তের ভিত্তিতে প্রকৃত দখলদার নির্ণয় করা হতে পারে। এরপর আইনানুগভাবে উচ্ছেদের আদেশ দেওয়া হয়। আর বেশী সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে, আপনি সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চেয়ে দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে পারেন। আইনটির ৮ ধারা অনুযায়ী, আপনাকে ওই জমিতে স্বত্ব বা মালিকানা আছে বলে প্রমাণ দিতে হবে। এ ধারার স্বত্ব প্রমাণসহ মামলা করার ক্ষেত্রে বেদখল হওয়ার পর থেকে ১২ বছরের মধ্যে মোকদ্দমা দায়ের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জমির মূল্যের ওপর ভিত্তি করে সেই অনুপাতে কোর্ট ফি জমা দিতে হয়।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮