এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
জমি-জমা নিয়ে যে কোন ধরণের চুক্তি সম্পদিত হয়েছে, যেমন বায়না করেছেন, কিন্তু এখন তিনি জমি রেজিষ্ট্রি করে দিচ্ছেন না, নানারককম তালবাহানা করছেন। বায়না দলিল অনুযায়ী আপনি জমি রেজিষ্ট্রি করিয়ে দিতে বাধ্য করতে পারবেন কিংবা ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবেন। এ মামলাকে চুক্তি প্রবলের মামলা বা এনফোর্সমেন্ট অব কনট্যাক্ট মামলা বলা হয়ে থাকে।
আবার অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন বায়নানামা হয়েছে কিন্তু বায়নানামা রেজিষ্ট্রি হয়নি শুধুমাত্র ষ্ট্যাম্পে বায়না লেখা হয়েছে, তাহলে কি করবেন। আবার জমি বায়ননামা করেছে, কিন্তু গ্রহীতা বক্রি টাকা পরিশোধ করে জমি লিখে নিতে গড়িমসি করছে-সেক্ষেত্রে জমি দাতা কিভাবে চুক্তি রদ করতে পারবেন এবং ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারবেন-উভয় পক্ষের ডিফেন্স জানতে আলোচনা জানুন।
জমি বায়নানামা করার পর অর্থাৎ চুক্তি সম্পাদনের পর কোন পক্ষ যদি চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে বা চুক্তি অস্বীকার করে তাহলে ভুক্তভোগী পক্ষ সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭ এর ১২ ধারা মতে আদালতে চুক্তি প্রবলের মামলা করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, এরকম মামলা করতে হলে চুক্তি সম্পাদনের তারিখ হতে বা চুক্তি অস্বীকারের তারিখ হতে এক বছরের মধ্যে করতে হবে। এ আইনের ২১ এ ধারার বিধান অনুসারে আদালতের মাধ্যমে চুক্তি বলবত করতে হলে আপনাকে দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে।
১। চুক্তি বা বায়নানামাটি লিখিত ও রেজিস্ট্রিকৃত হতে হবে নতুবা চুক্তি প্রবলের মামলা আদালতের মাধ্যমে বলবৎ করা যাবে না। ২। বায়নার অবশিষ্ট টাকা আদালতে জমা না করলে এ মামলা দায়ের করা যাবে না।
২০০৫ সালের আগে বায়না দলিল রেজিস্ট্রি না করলেও চলতো। কাজেই বায়না দলিল রেজিস্ট্রি না করলে মামলা করে বলবৎ করা যাবে না। তবে হতাশ হওয়ার কারণ নেই। বায়না দলিল রেজিস্ট্রি না হলেও বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। আপনি ফৌজদারি আদালতে দন্ডবিধি আইনে মামলাও করতে পারেন। যেমন প্রতারণা করার উদ্দেশ্যে চুক্তি প্রতিপালন না করা। এই অপরাধের জন্য দÐবিধির ৪২০ ধারায় সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রতারণার মামলা করে আসামীকে জেল ও জরিমানা দিতে পারেন।
চুক্তি প্রবলের মামলা ছাড়াও অন্যভাবে বিভিন্ন প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায়। যেমন আপনি দেওয়ানি আদালতে ক্ষতিপূরণের মামলা করে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেন। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ধরুন রহিম করিমের কাছে ৫ বিঘা জমি বিক্রির জন্য বায়না করল। পরে দেখা গেল রহিম ৪ বিঘা জমির মালিক, বাকি এক বিঘা জমির মালিক তার ভাই কালাম। এখন দেওয়ানি আদালতে মামলা করলে ৫ বিঘা জমি করিমকে রেজিস্ট্রি করে দেয়ার জন্য রায় দিতে পারে না। এই ক্ষেত্রে ৪ বিঘা জমি রেজিস্ট্রি করে দেয়ার জন্য রায় দিতে পারে। বাকি এক বিঘা জমির ব্যাপারে ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দিতে পারে। আর চুক্তি প্রবলের মামলা করলে আদালত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দলিল রেজিস্ট্রি করিয়ে দেয়ার আদেশ দিতে পারেন। আদেশ অনুযায়ী দলিল করে না দিলে আদালতের তরফ থেকে দলিল রেজিস্ট্রি করে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন।
এখন জানার বিষয় হচ্ছে যে, এ মামলা করতে কত টাকা খরচ হবে। কোর্ট ফিস এ্যাক্ট, ১৮৭০ এর ৭ ধারার (১০) উপধারা অনুযায়ী চুক্তি প্রবলের মামলায় চুক্তিকৃত পণ বা দাম অনুসারে মামলার মূল্য নির্ধারিত হবে। এখানে একটি বিষয় উভয় পক্ষকেই জেনে রাখা দরকার যে, চুক্তি প্রবলের জন্য যেমন মামলা করা যায়, তেমনি প্রয়োজনে চুক্তি রদের জন্যও জমি মালিক ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩৫ ধারায় মামলা করতে পারেন। তবে এ মামলাটি করতে হবে বায়নাগ্রহীতা জমি বক্রি টাকা পরিশোধ করে জমি লিখে নিতে গড়িমসি করছে এ বিষয়টি জানার বা বুঝতে পারার তারিখ হতে ৩ বছরের মধ্যে চুক্তি রদের মামলা করতে হয়। ক্রেতার ব্যর্থতার কারণে চুক্তিতে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ক্রেতা জমি কবলা রেজিস্ট্রি করে নিতে না পারলে চুক্তি ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং বায়নার টাকা বিক্রেতার অনুকুলে বাজেয়াপ্ত হবে।
সর্বশেষ আরেকটি বিষয় জেনে রাখা দরকার, চুক্তি করার পর চুক্তির শর্ত পালন না করে অন্য কারও সাথে একই রকমের চুক্তি সম্পাদন করলেও পরবর্তী চুক্তিটির কাজ করা হতে বিরত রাখার জন্য আপনি দেওয়ানী আদালতে নিষেধাজ্ঞা প্রার্থনা করে দরখাস্ত দায়ের করতে পারবেন।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮