মোঃ নূরুল হক
মানুষ, সভ্যতা ও আইন পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে যে সব বিষয়ের উন্নতি সাধিত হয়েছে তার মধ্যে সর্বপ্রধান ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আইনের বিকাশ। যদি প্রশ্ন করা হয় মানব সমাজে আইনের উৎপত্তি কবে? তার জবাবে অনেকে বলে থাকেন যখন থেকে সম্পত্তিতে ব্যক্তি মালিকানার সৃষ্টি হয়েছে তখন থেকেই আইনের যাত্রা শুরু। এর আগে মানব সমাজে আইন ছিল না। ছিল বিনিময় প্রথা ও রীতি-নীতি। কিন্তু বাস্তব সত্য হল যে দিন স্রষ্টা আদি মানব হযরত আদম (আ:) কে সৃষ্টি করে স্বর্গেপ্রেরণ করলেন এবং তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র নির্ধারণ করে দিলেন তখন থেকেই মানব সমাজে আইনের যাত্রা শুরু এবং তা হল।
প্রাকৃতিক আইন বা স্রষ্টার আইন।
যা হোক, বর্তমানে আইন বলতে বুঝায় “সার্বভৌম কর্তৃক গৃহীত কতকগুলো সুনির্দিষ্ট বিধি-বিধান যা মানুষের বাহ্যিক আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।” আবার অনেকে বলে থাকেন বিবেক প্রসূত রায় বা সিদ্ধান্তই আইন। অর্থাৎ আইন বিবেক হতে সৃষ্ট। আইন নিয়ে যা-ই বলা হোক না কেন আমরা আইনের সাগরে বাস করছি। আধুনিক সমাজে আইনের অনুশাসন, আইনের চোখে সবাই সমান কিংবা কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়- এরূপ কিছু শব্দমালার বা বাক্যের ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। এগুলোর একমাত্র উদ্দেশ্য হল সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। বলা হয়ে থাকে ন্যায়বিচার হল বিবেকের প্রতিবিম্ব। বিবেকের মরণ হলে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি অনিশ্চিত।
আবার, আত্মবোধও বিবেক উৎসারিত, তা ন্যায়ের পক্ষে। সুতরাং, বিবেক ও আত্মবোধ দু’টি শক্তিশালী আইনী হাতিয়ার। আবার, স্বাধীনতা ও নৈতিকতার সাথেও আইনের যথেষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। স্বাধীনতা মানেই ‘লাগামহীন কিছু’ নয়। বরং আইনের গন্ডি ভিতরে থেকে সবোর্চ্চ সুবিধা উপভোগ হল স্বাধীনতা। তাই প্রত্যেক জাতি চায় নিজস্ব স্বাধীনতা, নিজস্ব আইন।
নৈতিকতা না থাকলে আইন দিয়েও সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আইন ও নৈতিকতা এক দেহে দুই চোখ। বলা হয়ে থাকে- শাস্তির কঠোরতার জন্য আইন নয়, যে আইনের প্রতি সবাই শ্রদ্ধাশীল, সেরূপ আইন প্রয়োজন।
এবার একটু ভিন্ন বিষয়ে আসা যাক। যারা আইন নিয়ে কাজ করেন তাদের মধ্যে অন্যতম হল আইন ব্যবসায়ী তথা আইনজীবী। সম্ভবত পেশাগত জীবনে আইনজীবীদের নিয়েই সবচেয়ে বেশি কৌতুক প্রচলিত আছে। তার কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হল।
একদা সীমানা নিয়ে স্বর্গবাসী ও নরকবাসীদের মাঝে দ্ব›দ্ব হল। তখন স্বর্গবাসীরা গেলেন স্রষ্টার কাছে মামলা করতে। কিন্তু নরকবাসীরা সবাই হাসছে। তারা চেঁচিয়ে বলতে লাগল-মামলা করবে বটে, কিন্তু মামলায় লড়বে কারা? আইনজীবীরা যে সবাই আমাদের এখানে। হা ……হা……হা……………….
আরও একটা কৌতুক বলা যাক।
একবার স্বর্গে এক দম্পতির মাঝে বিরোধ হল। তখন তারা ছাড়াছাড়ির জন্য স্রষ্টার কাছে গেলেন। স্রষ্টা বললেন-তোমরা দশ হাজার বছর পর এসো। কারণ জানতে চাইলে স্রষ্টা বললেন- মামলায় লড়ার জন্য আইনজীবী দরকার। আর সম্ভবত জাহান্নাম থেকে আইনজীবীদের মুক্তি পেতে দশ হাজার বছর লাগবে।…..
এবার দুনিয়ার এক গল্পে আসা যাক। অনেকে বলে থাকেন আইন হল বোবা। যদি আইন কথা বলতে পারত , তাহলে তা সর্বপ্রথম আইনজীবীদের বিরূদ্ধেই অভিযোগ আনত।
এক ব্যক্তি তার নিকটতম প্রতিবেশী উকিলের চেম্বারে গেলেন। তিনি বললেন- উকিল সাহেব, আমায় পরামর্শ দিন। যদি কোন গৃহস্থীর কুকুর তার প্রতিবেশীর মুরগি খেয়ে ফেলে, তখন কি সে ক্ষতিপূরণ পাবে? উকিল সাহেব বললেন- হ্যাঁ পাবে , দুইশত টাকা ক্ষতিপূরণ। তখন ঐ ব্যক্তি বলল- তাহলে দেন দুইশত টাকা। কারণ, আপনার কুকুর আমার মুরগি খেয়ে ফেলেছে। তখন উকিল সাহেব দুইশত টাকা বের করে দিলে লোকটি চলে যাচ্ছিল- এমন অবস্থায় উকিল সাহেব বললেন- কয়, আমার ‘পরামর্শ ফি’ দিয়ে যান- চারশত টাকা!
এজন্য বলা হয়ে থাকে- আইনের মালা সবাই পরাতে চায়, কিন্তু কেউ নিজে পরতে চায় না। তারপরও আইনের অস্তিত্ব থাকা ভাল, তার অনস্তিত্ব দুর্বল জাতির পরিচায়ক।
বলাবাহুল্য, আমরা যেমন বাতাসের মাঝে বাস করেও মাঝেমাঝে বাতাসের অস্তিত্ব ভুলে যাই, তেমনি আইনের সাগরে বাস করেও আমরা মাঝেমাঝে আইনকে বেমালুম ভুলে যাই। আমরা না জেনে-বুঝে অনেক আইন-ই মানি, আবার অনেক আইন-ই ভঙ্গ করি। আইন ভঙ্গের জন্য রয়েছে শাস্তি। এই শাস্তি নিশ্চিত করতে গড়াতে হয় গ্রাম্য সালিশ থেকে শুরু করে আদালতপাড়া। কেউ পায় শাস্তি, কেউ পায় স্বস্তি।
আগে বলা হত আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের অবস্থাদৃষ্টে বলা যায়-আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে না বলে মানুষ যেদিকে চালাবে আইনও সেদিকে চলবে বলা উচিত।
অবশেষে একটি উদ্বৃত্তি দিয়ে লেখা শেষ করছি।
”বাদী-বিবাদীতে হয় বাক্-বিতন্ডা
সাক্ষী তাতে হয় ভাগ্য-নিয়ন্তা
বিচারক তাতে হন শেষকর্তা”
লেখকঃ মোঃ নূরুল হক,সহকারী জজ, গাইবান্ধা।