আবু মিছিল
আজকের আলোচনায় লেখকের ব্যক্তিজীবন বা দর্শনকে মূখ্য না ভেবে লেখার বিষয়বস্তুর দিকে বিনম্রভাবে মনোনিবেশ করতে পারলে কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে, যেসব উত্তর আমাদের চোঁখের সামনে এবং কানের কাছে অনবরত ভেসে বেড়ায়। কিন্তু সময় স্বল্পতায় পাত্তা দেয়া হয়নি। এখন হাতে অঢেল সময়। দশটি মিনিট না হয় এই লেখা নিয়েই ভাবলাম।
শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে সকল জীব মৃত্যু বরণ করবে। এই ধ্রুব সত্যটিকে সবচেয়ে এড়িয়ে যাওয়া সত্য বলে বিবেচিত হয়। মানুষ কি শুধু করোনায় মারা যায়? মৃত্যুর হাজার উপায়ের একটি উপায় হচ্ছে করোনা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অনেক মানুষ মারা যাবে। তবে কিছু লোকতো অবশ্যই বেঁচে থাকবে। এখন প্রশ্ন হলো জীবিত লোকজন কি অমর হয়ে যাবে? না, তা হওয়ার নয়। সূরা আল-ইমরান এর ১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, ” জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিবে। কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে তোমাদের কর্মফল পূর্ণ মাত্রায় দেওয়া হইবে। যাহাকে অগ্নি হইতে দূরে রাখা হইবে এবং জান্নাতে দাখিল করা হইবে সেই সফলকাম এবং পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়।” আমাদের পার্থিব জীবনকে একটি ভ্রমের সাথে তুলনা চলে। এক সেকেন্ড বেঁচে থাকার ভরসা নেই কিন্তু আমাদের শত বছরের পরিকল্পনা আছে। সূরা আনআম এর ৩২ নম্বর আয়াতে আছে, ” পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত আর কিছুই নয় এবং যাহারা তাক্ওয়া অবলম্বন করে তাহাদের জন্য আখিরাতের আবাসই শ্রেয় ; তোমরা কি অনুধাবন কর না ? “
আমাদের চতুর্দিকের নেয়ামতে পরিপূর্ণ জীবন আমাদের মোহগ্রস্ত করে রাখে। পরিবার, সম্পদ, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি আমাদের এমনভাবে গ্রাস করে যে, আমরা মৃত্যুর মতো ধ্রুব সত্যকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করি। সূরা আন’আম এর ৪৪-৪৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, ” অতঃপর যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে উপদেশ এবং দিক-নির্দেশনা দেওয়া হলো, তারা তা ভুলে গেল ( আল্লাহর কথাকে তুচ্ছ ভেবে প্রত্যাখ্যান করলো ) তাদের এই সীমালংঘনের পর আমি তাদের জন্যে প্রতিটি কল্যাণকর বস্তুর দরজা খুলে দিলাম অর্থাৎ তাদের জন্যে ভোগ বিলাসিতা, খাদ্য সরঞ্জাম, প্রত্যেক সেক্টরে সফলতা, উন্নতি এবং উন্নয়ন বৃদ্ধির দরজাসমূহ খুলে দিলাম । শেষ পর্যন্ত যখন তারা আমার দানকৃত কল্যাণকর বস্তু সমূহ পাওয়ার পর আনন্দিত, উল্লাসীত এবং গর্বিত হয়ে উঠলো, তারপর হঠাৎ একদিন আমি সমস্ত কল্যাণকর বস্তুর দরজা সমূহ বা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার দরজাসমূহ বন্ধ করে দিলাম । আর তারা সেই অবস্থায় হতাশ হয়ে পড়লো । তারপর এই অত্যাচারী সম্প্রদায়ের মূল শিকড় কর্তিত হয়ে গেল এবং সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্যেই রইলো, যিনি বিশ্বজগতের কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনকারী বা সবকিছুর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণকারী “রব”।”
উপরের আয়াতটুকু আরেকবার পড়ুন! দেখুন আমাদের আধুনিক সুযোগ সুবিধা, বিত্ত-বৈভব, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সবই আছে। কিন্তু কোনো কাজে আসছে না। স্পেনের রাজকুমারী মারা গেছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী আক্রান্ত হয়েছেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী আইসিইউতে ছিলেন। এগুলো কি আমাদের মানবিক অসহায়ত্ব প্রমাণ করে না? আমাদের ক্রমাগত সীমালঙ্ঘন, অন্যায়, অবিচার আর জুলুমবাজির ফলাফল তামাম দুনিয়ার স্থবিরতা। কোনো শক্তি আজ কাজে আসছে না। মৃত্যু আজ কেবলই সংখ্যা আর পরিসংখ্যানের টালি খাতার হিসেবের খোড়াক। সূরা আর-রূম এর ৪১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, ” মানুষের কৃতকর্মের দরুণ স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়াইয়া পড়ে; যাহার ফলে উহাদেরকে উহাদের কোন কোন কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাহাতে উহারা ফিরিয়া আসে।” আপনি হয়তো বিজ্ঞানমনষ্ক হয়ে ভাবছেন, করোনা ভাইরাস চিনের ল্যাবে তৈরি অথবা আমেরিকার চক্রান্ত। আপনি যে ষড়যন্ত্র তত্ত্বই সামনে আনুন না কেন, আপনি বিশ্বাসী হলে নিচের আয়াতটি দেখুন। সূরা তাগাবুন এর ১১ নম্বর আয়াতে এসেছে, ” আল্লাহ্র অনুমতি ব্যতিরেকে কোন বিপদই আপতিত হয় না এবং যে আল্লাহ্কে বিশ্বাস করে তিনি তাহার অন্তরকে সুপথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত। ” আল্লাহ পাকের হুকুম ছাড়া কিছুই হয়না। সেটা তিনি চিন, যুক্তরাষ্ট্র বা ফেরেশতাকুল যাদের দিয়েই করান না কেন। বর্তমানে আমরা যেসকল বালা মুছিবতের মুখোমুখি হচ্ছি তার অনেক বর্ণনা পবিত্র কুরআন পাকে বর্ণিত আছে।
সূরা আ’রাফ এর ১৩৩ নম্বর আয়াতে আছে,
” শেষ পর্যন্ত আমি এই জাতিদেরকে পোকামাকড় বা পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ, রক্ত, প্লাবন ইত্যাদি দ্বারা শাস্তি দিয়ে ক্লিষ্ট করি। ” এবং সূরা বাকারার ২৬ নম্বর আয়াতে আছে, ” নিশ্চয়ই আল্লাহ্ মশা কিংবা এর চাইতেও তুচ্ছ বিষয় ( ভাইরাস বা জীবাণু ) দিয়ে উদাহরণ বা তাঁর নিদর্শন প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। “
আমরা জীবনের প্রতি এতোটাই বেপরোয়া যে, এই মাটির দেহ আত্মা ত্যাগ করবে তা ভাবতেই নারাজ। আল্লাহ পাক সূরা আল-বাকারা এর ৯৬ নম্বর আয়াতে বলেন, ” তুমি নিশ্চয়ই তাহাদেরকে জীবনের প্রতি সমস্ত মানুষ, এমন কি মুশরিক অপেক্ষাও অধিক লোভী দেখিতে পাইবে। তাহাদের প্রত্যেকে আকাঙ্ক্ষা করে যদি সহস্র বৎসর আয়ু দেওয়া হইত; কিন্তু দীর্ঘায়ু তাহাকে শাস্তি হইতে দূরে রাখিতে পারিবে না। তাহারা যাহা করে আল্লাহ্ উহার দ্রষ্টা।”
কী বুঝলেন? হাজার বছর আয়ু পেলেও মৃত্যু হবেই। হিসেব থেকে তো নিস্তার নেই। পরকালের জন্য
কী অর্জন করলাম? নিঃসন্দেহে আল্লাহ পাক আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন। এই সময়ে আমাদের স্বার্থপরতা, ঘৃণা, দলাদলি, অহংকার, অসাম্য, অন্যায্যতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। নিজেদের ভুলচুক শুধরে নিতে হবে। সূরা আন-আম এর ৪২ নম্বর আয়াতে এসেছে, ” তারপর আমি তাদের উপর রোগব্যাধি, অভাব, দারিদ্র্য, ক্ষুধা চাপিয়ে দিয়েছিলাম, যেন তারা আমার কাছে নম্রতাসহ নতি স্বীকার করে। ” একইভাবে এই প্রসঙ্গে সূরা আ’রাফ এর ৯৪ নম্বর আয়াতে আছে, ” ওর অধিবাসীদেরকে আমি দুঃখ, দারিদ্র্য, রোগ-ব্যাধি এবং অভাব-অনটন দ্বারা আক্রান্ত করে থাকি । উদ্দেশ্য হলো তারা যেন, নম্র এবং বিনয়ী হয়। ” এছাড়াও একই প্রসঙ্গে সূরা আল-বাকারা এর ১৫৫ নম্বর আয়াতে আছে, ” আমি তোমাদেরকে কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করিব। তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলগণকে। ” আল্লাহ পাক মুমিন ও সবুরকারীদের জন্য সুসংবাদ দিয়েছেন, অভয় দিয়েছেন। সূরা আল-বাকারা এর ১৫৩ নম্বর আয়াতে এসেছে, ” হে মু’মিনগণ! ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। ” আল্লাহ পাক সূরা আনফাল এর ৩৩ নম্বর আয়াতে আরো বলেন,
” আল্লাহ্ এমন নন যে, তুমি তাহাদের মধ্যে থাকিবে, অথচ তিনি তাহাদেরকে শাস্তি দিবেন, এবং আল্লাহ্ এমনও নন যে, তাহারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে অথচ তিনি তাহাদেরকে শাস্তি দিবেন। “
মহান দয়ালু আল্লাহ পাক আমাদের মাফ চাইতে বলেছেন। আমাদের ক্ষমা চাওয়া তিনি পছন্দ করেন।
সূরা আল-বাকারা এর ১৬০ নম্বর আয়াতে তিনি বলেন, ” কিন্তু যাহারা তওবা করে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করে আর সত্যকে সুস্পষ্ট ভাবে ব্যক্ত করে, ইহারাই তাহারা যাহাদের তওবা আমি কবুল করি, আমি অতিশয় তওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু। “
আল্লাহ পাক আমাদেরকে প্রত্যাবর্তনের আহ্ববান জানান। আমাদের ভুলত্রুটি থেকে মাফ চেয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তিনি আমাদের ফেরাবেন না নিশ্চয়ই।
সূরা আল-বাকারা এর ১১২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, ” হ্যাঁ, যে কেহ আল্লাহ্র নিকট সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করে এবং সৎ কর্মপরায়ণ হয় তাহার ফল তাহার প্রতিপালকের নিকট রহিয়াছে এবং তাহাদের কোন ভয় নাই ও তাহারা দুঃখিত হইবে না।”
আমরা নিদারুণ কষ্ট ভোগ করছি এখন। আমাদের সাহায্যকারী কাউকে পাচ্ছি না। একাগ্রচিত্তে মাওলা পাককে ডাকলে তিনি সাড়া দিবেন বলেই বিশ্বাস করি। সূরা আদ্ব-দ্বোহা এর ৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, ” অচিরেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে অনুগ্রহ দান করিবেন আর তুমি সন্তুষ্ট হইবে। “
কিন্তু আমরা মানুষেরা নিতান্তই নিমকহারাম। আমরা অকৃতজ্ঞ। মহান আল্লাহ আমাদের স্বভাব সম্পর্কে জানেন। তাইতো তিনি সতর্ক করে সূরা হুদ এর ১০ নম্বর আয়াতে বলেন, ” আর যদি দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করিবার পর আমি তাহাকে সুখ-সম্পদ আস্বাদন করাই তখন সে অবশ্যই বলিবে, আমার বিপদ-আপদ কাটিয়ে গিয়াছে, আর সে তো উৎফুল্ল ও অহংকারী।”
এবার আসুন এক অমোঘ সত্য মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে শিখি। আমরা মরার পরের জীবনের জন্য প্রস্তুত নই বলেই মৃত্যুকে মেনে নিতে পেরেশানবোধ করি। কিন্তু যেই অলংঘনীয় বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, তাকে ভালোভাবে আলিংগন করার চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। মৃত্যু বিষয়ে কিছু আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ” হে নবী! তোমার পূর্বেও আমি কোন মানুষকে অমরত্ব দান করিনি। তোমার মৃত্যু হলে ওরা কি চিরকাল বেঁচে থাকবে?” (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৩৪)
” নিশ্চয়ই মৃত্যুর সময় নির্ধারিত। আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো মৃত্যু হতে পারে না। কেউ পার্থিব পুরস্কারের জন্যে কাজ করলে তাকে তার পুরস্কার ইহকালে দান করবো। আর যদি কেউ পরকালের জন্যে কাজ করে তবে তার পুরস্কার সে পরকালে পাবে। শোকরগোজার বান্দাদের কাজের ফল আমি নিশ্চয়ই দেবো।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৪৫)
” দূরাচারীরা কি মনে করে যে, তাদের জীবন ও মৃত্যু এবং বিশ্বাসী ও সৎকর্মশীলদের জীবন ও মৃত্যু একইরকম হবে? কত ভ্রান্ত ধারণা ওদের!” (সূরা জাসিয়া, আয়াত ২১)
” সত্যের পথে তোমরা স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করো বা নিহত হও, তোমরা আল্লাহর কাছেই সমবেত হবে।”
(সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৫৮)
আল্লাহ পাক আমাদের আখিরাতের প্রস্তুতিসহ মৃত্যু নসীব করুন। আমিন।
এবার ভাবুন, করোনায় বেঁচে গেলে কী করবো? কেমন জীবন যাপন করবো? তখনো কি ফাইল সই করতে টাকা লাগবে? অন্যের অধিকার বঞ্চিত করবো? ক্ষমতার দম্ভে অংহকারে মাটি কাঁপবে?
মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থেকেই যাবে? আরো শত প্রশ্নের উত্তর গুছিয়ে নেয়ার সময় এখনই। কারণ এমন অলস বসে থেকে জীবন নিয়ে ভাবার ফুসরত কখনো পাইনি। ভবিষ্যতেও যদি না পাই!
লেখকঃ সমাজকর্মী ও কলামিস্ট।
মতামতের জন্য লেখক দায়ী থাকিবেন।