সব
facebook apsnews24.com
খাদ্য সংকট মোকাবেলায় করণীয় কী - APSNews24.Com

খাদ্য সংকট মোকাবেলায় করণীয় কী

খাদ্য সংকট মোকাবেলায় করণীয় কী

জিয়া হাসান

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি করোনাজনিত অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় মূল্যস্ফীতি হলেও টাকা ছাপিয়ে হতদরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করতে পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরাও একই পরামর্শ সরকারকে দিচ্ছেন। কিন্তু অপরীক্ষিত এ প্রস্তাবটি বিপজ্জনক এবং আমাদের হাতে বিকল্প পথ রয়েছে।

এ পরামর্শের পেছনে দুটি ভাবনা থাকতে পারে। মডার্ন মনিটারি থিওরি এবং অমর্ত্য সেনের বিখ্যাত গবেষণা যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে পণ্য সহায়তা দেয়া অপেক্ষা অর্থ সাহায্য দেয়া বেশি কার্যকর।

মূল্যস্ফীতিকে উপেক্ষা করে টাকা ছাপিয়ে বাজেট ঘাটতি পূরণের  ধারণাটা সাম্প্রতিককালে আলোচিত হয়েছে। তবে বলা হচ্ছে মডার্ন মনিটারি থিওরি। এ তত্ত্বে বলা হচ্ছে, যেহেতু সার্বভৌম রাষ্ট্র তাদের ইচ্ছামতো মুদ্রা তৈরি করতে পারে এবং রাষ্ট্রের তৈরি করা মুদ্রার পরিমাণ স্বর্ণ বা রুপা বা অন্য কোনো কিছুর পরিমাণের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং রাষ্ট্রীয় আদেশেই চাহিদা-জোগানের ভিত্তিতে একটি মুদ্রার মান তৈরি হয় এবং যেহেতু সাম্প্রতিক কালে পাশ্চাত্যের দেশ মনিটারিজমের তত্ত্বমতে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, তাই সরকারগুলো টাকা ছাপিয়ে জনগণের কাছে সেই অর্থ বিলিয়ে দিক অথবা বাজেট ঘাটতি মেটাক।

ষাটের দশকে প্রায়োগিক মনিটারিজমের জন্ম যখন অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান সফলভাবে ঐতিহাসিক উদাহরণ দিয়ে দেখাতে পেরেছিলেন যে অর্থ বেশি ছাপালে দীর্ঘমেয়াদে সব দেশের প্রাইস লেভেল মানে জিনিসপত্রের দাম বা নতুন অর্থের পরিমাণের সমান বৃদ্ধি পায়। তার পরের দুটি দশকে পাশ্চাত্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মূল্যস্ফীতি নিয়ে অনেক ধকল গেছে। তাই মনিটারিজম সাধারণ জ্ঞান হিসেবে ৪০ বছর টিকেছে। কিন্তু গত এক দশকে পাশ্চাত্যের বেশকিছু দেশে অর্থ ছাপানোর সঙ্গে সঙ্গে একই হারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে না।

ফলে এমএমটির তাত্ত্বিকরা প্রস্তাব করছেন ঋণ না নিয়ে অর্থ ছাপিয়েই সরকার ব্যয় মেটাক। এমএমটি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মাঝে বিতর্ক হচ্ছে। এমএমটির বিপক্ষের তাত্ত্বিকরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেখিয়ে প্রমাণ করছেন যে দীর্ঘমেয়াদে এমএমটি কখনই টিকবে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর দায় বাড়বে, মূল্যস্ফীতি হবে। আর পক্ষের তাত্ত্বিকরা দাবি করছেন, যেহেতু পাশ্চাত্যে বর্তমানে সুদের হার খুবই কম, সেহেতু টাকা ছাপিয়ে বিনিয়োগ করলে যে সম্পদ তৈরি হবে, সেই সম্পদের মুনাফা নির্দ্বিধায় ভবিষ্যৎ মূল্যস্ফীতি থেকে বেশি হবে। ফলে আগামী প্রজন্মকে আরো কম টাকা পরিশোধ করতে হবে। তাই এমএমটি অনুসরণ করে সব খরচ মেটাতে সরকার টাকা ছাপাতে থাকুক এবং জনগণের মাঝে বিতরণ করুক, যাকে বলা হচ্ছে হেলিকপ্টার মানি।

স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের যেকোনো সরকার এমএমটি ভালোবাসবে। কারণ উৎপাদন না করে, জনগণের ওপর ট্যাক্সের বোঝা  না বাড়িয়ে ইচ্ছামতো টাকা ছাপিয়ে খরচ করার যে খোলা চেক এমএমটি দেয়, সেটা কার না দরকার? এ তো রূপকথার সেই টাকার গাছ।

কয়েক দশক ধরে অর্থনীতির একটি অধিভৌতিক কলা হিসেবে মূলধারার বাইরে ঘোরাফেরা করার পর নভেল করোনাভাইরাসজনিত সংকটের পরে এমএমটি ও হেলিকপ্টার মানি শুধু মূলধারা নয়, বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক সংকট সমাধানের গুরুত্বপূর্ণ একটি পলিসি হিসেবে সামনে এসেছে। সব রাষ্ট্রেই অনুভূত হচ্ছে নভেল করোনাভাইরাস গত এক শতকের গভীরতম অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। এ সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে টাকা ছাপাও, টাকা বিলাও, টাকা ছাপাও, টাকা বিলাও।

এমনকি অভিজিেদর মতো দারিদ্র্যমুখী অর্থনীতিবিদরা ভারত সরকারকে টাকা ছাপিয়ে হেলিকপ্টার মানি বিতরণের পরামর্শ দিচ্ছেন। মূল্যস্ফীতি হলে হোক। ধারণাটি হচ্ছে, টাকা ছাপিয়ে নিম্নবিত্তের হাতে পৌঁছে দিলে তারা নিজেরাও বাঁচবে আবার অর্থ খরচ করবে। এতে নতুন চাহিদা তৈরি হবে। যে চাহিদা অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করবে। 

১৯৩০-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে লর্ড মিল্টন কেইনস একই পরামর্শ দিয়েছিলেন। বর্তমান পরামর্শটির মূল সুরটা মিল্টন কেইনসের অর্থনৈতিক ভাবনা থেকেই এসেছে। এক্ষেত্রে পার্থক্য  হচ্ছে, কেইনস বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চার করতে চেয়েছেন। কিন্তু অভিজিৎ ব্যানার্জিরা হেলিকপ্টার মানির ধারণায় অর্থ বণ্টন করে অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চারের প্রস্তাব করছেন।

বাংলাদেশের অনেক অর্থনীতিবিদ অভিজিতের এ পরামর্শ সরকারের কানে তুলে দিয়েছেন।

প্রস্তাবটি নিয়ে আমার আপত্তি রয়েছে। আমার মতে, দরিদ্র ব্যক্তিদের  অর্থ সহায়তা দিতে হবে সরকারের বাকি খরচ থেকে কাটছাঁট করে। নতুন টাকা ছাপিয়ে নয়। লকডাউনের সময়ে যেহেতু সম্পদের উৎপাদন প্রায় থেমে গেছে, তাই এ সময়ের হেলিকপ্টার মানি প্রদান খাদ্যশস্যের পেছনে ব্যয় হবে এবং তার ফলে খাদ্যশস্যের মূল্যস্ফীতি ঘটতে পারে। তাই আমার মত, দরিদ্রদের জন্য সহায়তা দুই ভাগে ভাগ করে দেয়া উচিত। এক ভাগে থাকবে রেশনের মাধ্যমে খাদ্যপণ্য সহায়তা এবং অন্য ভাগে থাকবে হেলিকপ্টার মানি। এই অর্থ সহায়তাটি অর্থ না ছাপিয়ে এবং এডিপি ও সরকারের ব্যয় সংকোচন করে করা উচিত।

এ প্রস্তাবে মনিটারিজমপন্থী, কেঞ্জিয়ান সবাই হয়তো আপত্তি করবেন। তাই প্রস্তাবটি একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

ম্যাক্রো ইকোনমির তত্ত্বে অ্যাগ্রেগেট প্রাইস লেভেল ও অ্যাগ্রেগেট ডিমান্ডের বা সম্মিলিত মূল্য ও চাহিদার ধারণাটি খাতা-কলমে যেভাবে হিসাব করে হয়, বাস্তবে সম্মিলিত মূল্য বা সম্মিলিত চাহিদা সেভাবে কাজ করে না। সরকার যখন রাজস্ব ও মুদ্রানীতি দিয়ে অর্থ ও ঋণ সরবরাহ বৃদ্ধি করে অর্থনীতিকে ধাক্কা দিতে চায়, সেই অর্থ ও ঋণ নির্দিষ্ট কিছু চ্যানেল ও কম্পার্টমেন্ট বা সেক্টরের ভেতর দিয়ে অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। অনেক সময় প্রাথমিকভাবে যেসব চ্যানেলে বা সেক্টরে অর্থ খরচ করা হয়, অর্থ ও ঋণের বড় একটা অংশ ওই চ্যানেলে আটকা পড়ে এবং ওই কম্পার্টমেন্টের ভোক্তাদের ঋণ বা মূল্যস্ফীতি ঘটায়।

ফলে অর্থ সরবরাহ বা ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর ফলে অর্থনীতিতে যে মূল্যস্ফীতি ঘটে, তা সময়ে অ্যাগ্রেগেট লেভেলে বা সম্মিলিত পর্যায়ে হয় না, ওই ঋণ ও অর্থ সরবরাহ প্রধান যে চ্যানেল এবং কম্পার্টমেন্টে ঢোকে, সেসব চ্যানেল ও কম্পার্টমেন্টেই বেশি বৃদ্ধি পায় এবং সেসব সেক্টরেই মূল্যস্ফীতি বেশি হয়, বেতন বৃদ্ধি পায় এবং প্রবৃদ্ধি হয়। গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখতে পারি, অর্থ ও ঋণ সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে অস্ট্রেলিয়ায় গৃহস্থালি সম্পদের পণ্যমূল্য বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, জাপানে পাবলিক সেক্টরে ঋণের পরিমাণ জিডিপির ২৫০ শতাংশে পৌঁছেছে, চীনের ক্ষেত্রে ঋণ ও মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বেশি পড়েছে করপোরেট সেক্টরে এবং ক্যাপিটাল মার্কেটে, যেখানে বিভিন্ন রকম বাবল তৈরি হয়েছে অতিরিক্ত অর্থ ও ঋণপ্রবাহের কারণে।  

এ মুহূর্তে বাংলাদেশে ব্যাপক খাদ্য সংকট রয়েছে। এ খাদ্য সংকট মেটাতে সরকার দরিদ্রদের যদি অর্থ দেয়, তবে খুব কম সময়ের মধ্যে খাদ্যশস্যের একটি মূল্যস্ফীতি হবে। কারণ হেলিকপ্টার মানির বড় একটা অংশ খাদ্যশস্যের পেছনে ব্যয় হবে। ঠিক এ মুহূর্তে বাজারে মজুদ খাদ্যশস্যের পরিমাণ স্থির এবং আগামী কিছুদিনেও নতুন চাল বাজারে আসা পর্যন্ত এই পরিমাণ স্থির থাকবে। একই সঙ্গে সামনের অনিশ্চয়তা মাথায় রেখে অনেক সমর্থ পরিবার একই সময়ে খাদ্য মজুদ করতে চাইবে। এ অবস্থায় সামান্য মূল্যস্ফীতি ভোক্তা পর্যায়ে একটি মজুদের প্রবণতা তৈরি করতে পারে।

এ অবস্থায় সরকারের জন্য হেলিকপ্টার মানি অপেক্ষা সরকারি গুদাম থেকে খাদ্যশস্য রেশনের মাধ্যমে বণ্টন করলে দরিদ্রদের সুবিধা অপেক্ষাকৃত বেশি হবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা থাকবে না। এমনকি খাদ্য বিতরণে দুর্নীতিও সেই মজুদের বড় একটা অংশ সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারে ফিরে আসতে পারে।   

এ অবস্থায় বর্তমান সময়ের খাদ্য সংকট দূর করার জন্য আমার প্রস্তাব হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার এ মুহূর্তে তার গুদামে রাখা ১৫ লাখ টন মজুদ থেকে ৭০ বা ৮০ শতাংশ রেশনের মাধ্যমে খাদ্য সংকটে পতিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টন করুক। এতে তত্ক্ষণাত্ভাবে খাদ্য সংকটটি দূর হবে, কিন্তু খাদ্যশস্যের দাম বাড়বে না। বরং অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে খাদ্যশস্যের মূল্য হ্রাস পাবে।

একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের উচিত আরো প্রায় ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ফিউচারস মার্কেটের মাধ্যমে সামনের কোনো তারিখে সরবরাহের চুক্তিতে কিনে রাখা।

বর্তমান লকডাউনের কালে পণ্য উৎপাদন প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ। সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে। ফলে বাজারের সরবরাহ ব্যবস্থায় বিবিধ প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় মজুদদার চক্রগুলোও সক্রিয়। আন্তর্জাতিকভাবে চালের দাম মাত্র এক মাসে ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে গত তিন বছরের সর্বোচ্চ রেটে অবস্থান করছে। 

এ অবস্থায় যেকোনো মুহূর্তে খাদ্যপণ্য, বিশেষত চালের দাম অপ্রত্যাশিতভাবে আকাশে উঠে যেতে পারে।

যেহেতু এ মুহূর্তে বাংলাদেশের যথেষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে, ফলে রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার করে বাংলাদেশ সহজেই ফিউচারস মার্কেট থেকে বড় পরিমাণ খাদ্যশস্য কিনে রাখতে পারে। ওই শস্য সরকার স্ট্র্যাটেজিক রিজার্ভ হিসেবে রেখে দিতে পারে এবং ফিউচারস মার্কেট থেকে কেনার কারণে ওই পণ্যগুলো সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে গুদামে ঢোকাতে হবে না। আগামীতে বোরো উৎপাদন হলে বোরোর উৎপাদন সরকার গুদামে ঢুকিয়ে রাখতে পারবে। সরকার বোরোর উৎপাদন থেকেও বড় একটা অংশ রেশনের মাধ্যমে সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু যেহেতু সরকারের আন্তর্জাতিক বাজারে কেনা পণ্য মজুদ রয়েছে, ফলে আপত্কালীন মজুদ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না। ফলে বাংলাদেশে আগামী কয়েক মাসের জন্য কোনো ধরনের খাদ্য সংকটের সুযোগ থাকবে না।

একই সঙ্গে দরিদ্র মানুষের কাছে খাবার কেনার জন্য অর্থ না দিয়ে সরকারি গুদাম থেকে রেশনের মাধ্যমে সরাসরি খাদ্য সরবরাহ দিলে বিদ্যমান মজুদের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে না। চাহিদার সংকটের কারণে চালের দাম স্থিতিশীল থাকবে। একই সঙ্গে দরিদ্র মানুষের খাদ্য সংকট দূর হবে। অন্যদিকে অর্থ সহায়তা খাদ্যবহির্ভূত আইটেমের চাহিদা তৈরি করে অর্থনীতিতে প্রাণ ফিরিয়ে আনবে।

আমার আপত্তি হচ্ছে, অভিজিৎ ব্যানার্জির পরামর্শ মতো নতুন টাকা ছাপিয়ে খরচ করা যাবে না। এ খরচটি করতে হবে সরকারের ব্যয় কমিয়ে।

স্বাভাবিকভাবেই এ প্রস্তাবে যেকোনো মূলধারার অর্থনীতিবিদ আপত্তি করবেন। কারণ ৮০ বছর ধরে অর্থনীতির সবচেয়ে প্রধান ভাবনা কেঞ্জিয়ানিজম।

এ অর্থ ছাপানোর নীতি বিরোধিতা করার সুনির্দিষ্ট দুটি কারণ রয়েছে। 

কেঞ্জিয়ানিজম অবশ্যই কার্যকর। কিন্তু রাজস্বনীতির মাধ্যমে নতুন ইনভেস্টমেন্ট করে বিনিয়োগ বাড়িয়ে প্রবৃদ্ধি তৈরির যে ভাবনা, বাংলাদেশে তা কতটুকু কার্যকর হচ্ছে—এ নিয়ে প্রশ্নের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান ২ লাখ কোটি টাকা এডিপির খরচের তিনটি উল্লেখযোগ্য দিক রয়েছে। প্রথম দিকটি  হচ্ছে, এডিপির বড় একটি অংশ অকার্যকর প্রকল্প দিয়ে সাজানো হয়। দ্বিতীয় দিক হচ্ছে, ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে দুর্নীতি ও লুট। তৃতীয় দিকটি হচ্ছে, বর্তমান এডিপির প্রকল্পগুলোর বড় একটি অংশ বিদেশী ও স্থানীয় কনসালট্যান্টের পেছনে এবং টেকনিক্যাল কাজে ব্যয় হয়, যার সুফল দেশে থাকে না। এছাড়া এডিপির বড় একটি অংশ আবার আমদানি করতে হয়, যা স্থানীয়ভাবে বিনিয়োগ হয় না এবং কোনো স্থানীয় ভ্যালু যোগ করে না।

ফলে টেকনোলজির অভূতপূর্ব উন্নয়নের পরে বাংলাদেশের মতো নিম্ন নলেজ ক্যাপিটালের দেশে এডিপির কত বড় অংশ আসলে স্থানীয় অর্থনীতি ও স্থানীয় কনজাম্পশনকে ধাক্কা দেয় ও কর্মসংস্থান তৈরি করে এবং কত অংশ দুর্নীতির কারণে প্রকৃত বিনিয়োগ হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ফলে বাংলাদেশে সরকারি বিনিয়োগে কেঞ্জিয়ানিজম থিওরির কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ।

অবশ্যই কিছু অংশ চুইয়ে পড়ে। সরকারি প্রকল্পে বিনিয়োগের কারণে আমলাদের দুর্নীতি থেকে কন্ট্রাক্টর, কনসালট্যান্ট, সিমেন্ট ম্যানুফাকচারার, ফান্ড ম্যানেজার, ক্রেডিট রেটিং অফিসারসহ শহরকেন্দ্রিক বড় একটা গোষ্ঠীর বিভিন্ন রকম আয় হয়। তাদের আয় থেকে পিয়ন, চাপরাশি, ড্রাইভার, আয়া, বুয়া—সব মিলিয়ে তাদের বণ্টন অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিতে চুইয়েও পড়ে বটে।

কিন্তু সেই চুইয়ে পড়ার পরিমাণ খুবই সামান্য। তাই বর্তমান দুর্যোগকালে সঠিক পরামর্শ হলো, এডিপি কমিয়ে এডিপির টাকা সরাসরি নাগরিদের কাছে বণ্টন করা হোক। কোনো ধরনের নতুন টাকা ছাপানোর প্রয়োজন নেই।

বাংলাদেশের মতো সীমাহীন দুর্নীতির দেশে যেখানে পাপিয়ারা কোটি টাকায় ফাইভ স্টার হোটেলে মাসব্যাপী রুম ভাড়া রাখে, জিকে শামিমের বিলাসী জীবন, ৩ হাজার কোটি টাকার ঘুষের অর্থের বড় একটি অংশ কেঞ্জিয়ান বিনিয়োগ।

তাই লর্ড কিনসের থিওরি ত্রিশের মহামন্দা থেকে রাষ্ট্রের ডিমান্ড চাহিদা বাড়ানোর বুদ্ধি দিয়ে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে যে গতি সঞ্চার করেছে, সেই একই তত্ত্ব বাংলাদেশের দুর্নীতিমগ্ন ডুয়াল অর্থনীতিতে মন্দার সময়ে একই গতি নিয়ে আসবে ভাবাটা ভুল হবে।

তাই আমার ভাবনাটি হচ্ছে, দরিদ্রদের অর্থ সাহায্যটি দিতে হবে এডিপির অর্থ কাটছাঁট করে। সরাসরি বণ্টন করতে হবে। কিন্তু টাকা ছাপিয়ে নয়।

বাংলাদেশের গত আট মাসে ২ লাখ কোটি টাকা এডিপি থেকে মাত্র ৩০ শতাংশ খরচ হয়েছে। ফলে আগামী চার মাসে বাকি ১ দশমিক ৬ লাখ কোটি টাকা খরচ করতে যে লুটের মচ্ছব হবে, তার থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে এ অর্থ থেকে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা একটি আপত্কালীন ফান্ডে ট্রান্সফার করে সেই অর্থ দিয়ে হেলিকপ্টার মানি বণ্টন করা এবং আন্তর্জাতিক বাজার ও স্থানীয় বাজার থেকে খাদ্যশস্য কিনে তা দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করা; যা বাংলাদেশের প্রায় সাত কোটি মানুষের খাদ্য সংকট তত্ক্ষণাত্ভাবে দূর করবে এবং খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির কোনো সম্ভাবনা দূর করবে। কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কেনার মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিকেও একটি প্রণোদনা দেবেন।

বাংলাদেশের এমএমটি অনুসরণ করে টাকা ছাপিয়ে অর্থ বণ্টনের বিরোধিতার আরেকটি কারণ ডেবট সাইকেল।

দুই ধরনের  ঋণচক্র আছে—স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি। স্বল্পমেয়াদি ঋণচক্রের স্থায়িত্ব আট থেকে দশ বছর হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে একটি ঋণচক্রের শেষ পর্যায়ে রয়েছে, যার পরে এ ঋণগুলোর পরিশোধের সময় আসবে। ২০১০ সালের শেয়ারবাজারের সংকটের পর থেকে বাংলাদেশের সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চল্লিশ বছরের নিম্নঋণের ধারাবাহিকতা ভঙ্গ করে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে থাকে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি কুইক রেন্টাল কোম্পানিগুলো মূলত ২০১১ সাল থেকে শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে ২০১৬ সাল থেকে সঞ্চয়পত্র থেকে ব্যাপক পরিমাণ ঋণ নেয়া হয়েছে, যা নিয়ত ম্যাচিউর হচ্ছে। এ ঋণগুলো এখন ফেরত দেয়ার সময় এসেছে, যা বাংলাদেশের বাজেটে সুদের পরিমাণে দেখা যায়।

যা আবার দ্রুত একটা স্বল্পমেয়াদি ঋণচক্র তৈরি করছে। বাংলাদেশে ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত গ্রোথের পেছনে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের ব্যাপক পরিমাণ খেলাপি ও ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ, যা বিনিয়োগের ভূমিকা রয়েছে, যে ঋণ বিনিয়োগের বদলে ভোগ হয়েছে।

এসব ঋণের সুদাসল পরিশোধের সময় আসার কারণে খেলাপি  বেড়েছে এবং সরকার পুনঃতফসিল  করে মন্দ ঋণের বোঝাটা পেছনের তারিখে পাঠিয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ এ সংকটের আগেই একটি মন্দার ভেতরে পড়েছিল এবং বর্তমান অর্থনৈতিক বছরে সরকার সাত মাসে গত ৪৪ বছরের সমান ঋণ করেছে। ফলে সরকার এরই মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে টাকা ছাপিয়ে কিছু ঋণ পরিশোধ করছে এবং ঘাটতি বাজেট মেটাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে এই টাকা ছাপানোর পরিমাণ এমনিতেই বাড়বে।

এ অবস্থায় হেলিকপ্টার মানি বিতরণের জন্য আরো টাকা ছাপালে এবং তার নৈতিক বৈধতা দিলে বাংলাদেশ একটি হাইপার ইনফ্লেশনের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। এবং এ মূল্যস্ফীতির সূচনা হতে পারে খাদ্যশস্য দিয়ে। কারণ দরিদ্র ব্যক্তিরা এই অর্থের বড় একটা অংশ বাজারে অবস্থিত বিদ্যমান খাদ্যশস্য ক্রয়ে ব্যয় করবে। ফলে স্বল্প পরিমাণ পণ্যের পেছনে অতিরিক্ত টাকা ছোটাছুটি করে সেই পণ্যের মূল্যস্ফীতি তৈরি করবে।

তাই এই বহুমুখী সমস্যার একটি চলনসই সমাধান হচ্ছে খাদ্যশস্য সরকার নিজে কিনবে এবং বণ্টন করবে। কিন্তু খাদ্যশস্যবহির্ভূত পণ্যের জন্য হেলিকপ্টার মানি প্রদান করবে।

শুধু হেলিকপ্টার মানি দিয়ে দরিদ্রদের সাহায্য দিলে তা নিজেই দরিদ্রদের জন্য গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়াতে পারে।

তাই আমি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অভিজিৎ ব্যানার্জিদের পরামর্শ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিই।

লেখকঃ জিয়া হাসান: উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক।

আপনার মতামত লিখুন :

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

পারিবারিক আদালত আইন ২০২৩, যেসব বিষয় জানা জরুরী

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

সামাজিক ব্যাধি পরকীয়া: কারণ ও আইনী প্রতিকার

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরব গাঁথা মার্চ মাস

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

ফৌজদারী মামলা নিষ্পত্তি করতে কতজন সাক্ষী প্রয়োজন, আইন কি বলে!

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

বাংলা ভাষার সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত হোক

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

ইসলামী ব্যাংকিং পূর্ণতা পাওয়ার পথে সমস্যা: সমাধানের উপায়

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন  
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার: ApsNews24.Com (২০১২-২০২০)

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান
০১৬২৫৪৬১৮৭৬

editor@apsnews24.com, info@apsnews24.com
Developed By Feroj