এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
করোনার মত মহামারির ভ্যাকসিন বা টিকাও বাংলাদেশের আভ্যন্তরিন নোংরা রাজনীতির খেলা থেকে মুক্তি পেল না। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বার বারই টিকার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। টিকা নিয়ে সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে এমন সব প্রশ্ন তুলছেন বিরোধী দলের নেতারা তাতে গুজবের ডাল-পালা বিস্তার লাভ করছে। অন্যদিকে বিরোধী দলের অনেক নেতাদের বক্তব্যে তাদের মানষিক সুস্থতা সম্পর্কেও জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে।
ভানুর সেই গল্পের মত আর কি। ভানুর কাছে একজন এসে বললো মামা চাকরি পেয়েছি। ভানু : আরে চাকরি হবে না। ভাগ্নে : মামা, চাকরি হয়েছে। এই যে জয়নিং লেটার। ভানু : জয়েন করলেও বেতন পাবি না। ভাগ্নে : মামা বেতন পেয়েছি। ভানু : বেতন পেলেও এই টাকা বাজারে চলবে না। ….. করোনা টিকা নিয়ে বিরোধী দলের নেতাদের আচরনটা অনেকটাই এমন। পরীক্ষা মূলকভাবে টিাকা দেয়া শুরু হবার ৭২ ঘন্টা পরও যারা টিকা নিয়েছেন তারা সুস্থ থাকলেও বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিব বক্তব্য দিয়েছেন, “করোনা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সরকার টিকা দেয়ার কথা বলছে। এই টিকায় মানুষ বাঁচবে কী বাঁচবে না তা নিশ্চিত নয়।” তার এই বক্তব্য কতটা সুস্থ মানষিকতার পরিচয় বহন করে তা ভেবে দেখা উচিত।
প্রথমে বিরোধী দলের নেতারা বললেন, জানুয়ারির মধ্যে সরকার টিকা আনতে পারবে না। কিন্তু, যখন তার সময়ের মধ্যেই টিকা আনতে সক্ষম হলো, তখন বলা হলো করোনার টিকার বদলে মুরগির ভ্যাকসিন পাঠিয়ে দিয়েছে কিনা দেখতে হবে। তারপর যখন তাও সত্য হলো না তখন বলতে শুরু করলেন বিএনপির সমর্থকদের হত্রার উদ্দেশ্যেই ভুয়া টিকার আমদানি। এই টিকার মধ্য দিয়ে মানুষ আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। এরকম ভাবে একের পর এক দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য কতটা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন তারা।
করোনা মহামারির এই সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় করোনার টিকা। মানুষ এতকাল অপেক্ষা করেছিল টিকার জন্য। কিন্তু সব মানুষ টিকা নেবেন কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা শুরু হতে দেখা গেছে। অসত্য, অর্ধসত্য ও ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।
কোন টিকা কত দিন সুরক্ষা দেবে, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। এসব অনিশ্চয়তা থেকে সন্দেহ তৈরি হয়। সন্দেহ থেকে অনেকের মনে টিকার ব্যাপারে অনাগ্রহ তৈরি হতে পারে। অনেকের টিকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীরা কী সিদ্ধান্ত নেন, তার ওপর। টিকার দাম বা টিকা কোন দেশে তৈরি, এসব তথ্যও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে।
এ কথা সত্য, কাঙ্ক্ষিত করোনার এই টিকা কেবল প্রাণ বাঁচানোর মন্ত্র নয়, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বৈশ্বিক কূটনীতি, বিশাল অঙ্কের ব্যবসা। যে কোনো মহামারি ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় যেমন মানুষের সর্বোচ্চ মানবিকতা প্রদর্শিত হয়, তেমনি সুযোগের সৎব্যবহার করার বাসনায় প্রকাশ ঘটে সর্বোচ্চ প্রতারনারও। এরকম পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ সাবধানে থাকতে চায়। কিন্তু যখন প্রশ্নটা জীবন-মরণের তখন গুটিয়ে থাকার কোনো উপায় নেই।
গম্প্রীতি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী “করোনা টিকার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা” শীর্ষক আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘… টিকা বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য, সব মানুষের এটা নেওয়া উচিত।’
ইউরোপিয় ইউনিয়ন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের জন্য দাম দিচ্ছে ২.১৮ ডলার। আমেরিকা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন কিনতে যাচ্ছে ৪ ডলারে আর বাংলাদেশ সেই ভ্যাকসিন কিনতে হচ্ছে ৫ ডলারে। এটাই সম্ভবত বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সমালোচনা- কেন আমেরিকার চেয়ে বেশি মূল্যে বাংলাদেশ টিকা কিনছে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে এ আলোচনা গড়িয়েছে গণমাধ্যম পর্যন্ত। অনেকেই মনে করছেন, ভারত বোধহয় বেশি দাম নিচ্ছে। আসলে আমেরিকা টিকা আবিষ্কারের পেছনে শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকাকেই তারা দিয়েছে ১৬৫ কোটি পাউন্ড। টিকা ব্যর্থ হলে দাতাদের সম্পূর্ণ বিনিয়োগ নষ্ট হতো। তাই ইউরোপিয় ইউনিয়ন, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ দাতা দেশগুলো তুলনামূলক কম দামেই টিকা পাবে। আরেকটি বিষয় বিবেচ্য, টিকা উৎপাদনকালীন ট্রায়াল যদি অন্য দেশে হয় তাহলেও দ্রুত এবং স্বল্পমূল্যে টিকা পাবার অগ্রাধিকার পায় কোনো দেশ। সফল টিকার কোনো একটি ট্রায়াল যদি বাংলাদেশে হতো তাহলে বাংলাদেশও ইউরোপিয় ইউনিয়নের মতো কম দামে এই টিকা পেত। কিন্তু বাংলাদেশ বিনিয়োগ কিংবা ট্রায়াল কোনো প্রকার ঝুঁকিই নেয়নি। তাই ইউরোপ-আমেরিকার চেয়ে বাংলাদেশ বেশি দামে টিকা কিনছে। সুতরাং যারা এ ধরনের কথা তুলছেন হয় তারা বিষয়টি জানেন না, অথবা তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজ করছেন।
এদিকে টিকা গ্রহণের ফলে ভারতেও একজন মারা গেছেন এবং অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে খবর ছড়িয়েছে। জানা গেছে ৪২ বছর বয়সী দীপক মায়ারী নামে যে-শ্রমিক টিকা গ্রহণের ফলে মারা গেছেন সেটি ছিল বায়োটেকের মানব শরীরে পরীক্ষাধীন ‘কোভ্যাক্সিন’। এটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়-অ্যাস্ট্রাজেনেকার আবিষ্কৃত ও ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি ‘কোভিশিল্ড’ নয়। দীপক স্বেচ্ছায় সেটা নিতে রাজি হয়েছিলেন। সুতরাং ‘কোভিশিল্ড’ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে প্রচারণা চালাচ্ছে ভারত সরকার।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছেন এমন ৬৫ বছর বয়স্ক ও তার উপরে যাদের বয়স তারা, শিক্ষাকর্মী, জনপরিবহনের কর্মীরা। তবে দেশের জনগোষ্ঠীর দুটি অংশ আপাতত এই টিকা কর্মসূচির বাইরে থাকবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেছেন, ‘১৮ বছর বয়সের নিচে যারা তাদের উপর টিকার কোনো ট্রায়াল হয়নি। তাই তারা এই টিকা কর্মসূচির বাইরে থাকবে। দুই নম্বর হচ্ছে গর্ভবতী নারী, তাদেরও দেওয়া হবে না কারণ তাদের উপরেও ট্রায়াল হয়নি।
কিন্তু অনীহা আর বিভ্রাসিবদর কারণে সরকারের পরিকল্পনা কতটা বাস্তবায়িত হবে তা নিয়েও আলোচনা চলছে। শুধু বাংলাদেশ নয় যেসব দেশে টিকা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে সবখানেই শুরুতে টিকা নিয়ে জনগণের সন্দেহের বিষয়টি গণমাধ্যমগুলোতে উঠে এসেছে। তা দূর করার জন্য অনেক দেশে শুরুতে দায়িত্বশীল বা সরকার প্রধানদের টিকা নেয়ার নজিরও দেখা গেছে।
দেশে যখন করোনার টিকা নিয়ে রাজনীতি তীব্র হচ্ছে তখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এই রাজনীতিতে কার লাভ, কার ক্ষতি?
সর্বশেষ বিতর্কের জন্ম দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি দাবি করেন প্রথম করোনার টিকা নিতে হবে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে করোনা টিকা কেন নেয়া হলো সেটা নিয়েও রাজনীতি আছে। এই টিকা অক্সফোর্ডের হলেও এটাকে ভারতীয় ভ্যাকসিন হিসাবে আখ্যায়িত করে ও চলছে নানা কথা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেই দিয়েছেন যে ভারতের ভ্যাকসিনে তাদের আস্থা নাই। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে আগে ভ্যাকসিন দেয়ার নেয়ার আহ্বান জানান বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তারা ভারত বিরোধী রাজনীতির অংশ হিসাবেই কি এটা বলেছেন ? তারা কি জানেন না এটা ভারতের তৈরী কোন ভ্যাকসিন নয়। এই টিকা অক্সফোর্ডের। নাকি শুধু রাজনীতির কারণে বা ভারত বিরোধীতার কারণেই এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দিয়েছেন।
ডা.জাফরুল্লাহর দাবি, এই সরকার ব্যবসায়ীদের সরকার তাই সেরামের টিকা বেক্সিমকোর মাধ্যমে এনেছে। তারা কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই ফাও কত টাকা নিয়ে গেল। দামও বেশি নিচ্ছে। বেক্সিমকো সেরামের এখানকার প্রতিনিধি হলেও সরকার চাইলে এসেনসিয়াল ড্রাগস-এর মাধ্যমে আনতে পারত বলে তিনি মনে করেন। অবশ্য যারা ভারতের টিকা বলে কথা ছড়াচ্ছে তাদের সাথে নাই তিনি। তিনি বলেন, ”সেরাম ইনস্টিটিউট অক্সফের্ডের টিকা উৎপাদন করছে৷ আমার ওষুধও তো অনেক দেশ ব্যবহার করছে।”
টিকা নিয়ে যে সব রাজনৈতিক বক্তব্য চলছে তার সবই অনুমান-নির্ভর। অনুমান-নির্ভর ধারণা, যেহেতু টিকা ভারত থেকে আসছে, সেহেতু মানুষের ভেতরে অনীহা। এক্ষেত্রে ভারত-বিরোধী রাজনীতির প্রসঙ্গও সামনে চলে আসছে। বাস্তবতা কি তা বলে। মনে হয় তা বলৈ না। বাসবতা হলো ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি বাংলাদেশের মানুষ আস্থাশীল। প্রতি বছর কয়েক লাখ মানুষ ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নেন। যাদের অধিকাংশই ভারতে চিকিৎসা নিয়ে খুশি।
সরকার ও সরকারী দলের সমর্থকদেরও মনে রাখতে হবে বিরোধী দলের পক্ষের থেকে নেতাদের আগে ভ্যাকসিন নিতে বলাও কোনো অপরাধ নয়। কঠিন সময়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করেই নেতৃত্ব দিতে হয়। পৃথিবীর বহু নেতা ইতোমধ্যে নজির তৈরি করেছেন।
সমস্যা হলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনো যথেষ্ট পরিমাণ অগোছালো। তাদের কর্মকান্ডের কারনে জনগনের কাছে চ’ড়ান্তভাবে তারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তারা যা বলে, মানুষ তা বিশ্বাস করে না। ভ্যাকসিনের প্রতি মানুষের অনাস্থার এটা একটা বড় কারণ। আস্থা-বিশ্বাস অর্জনের জন্যে দরকার প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত প্রচারণা।
মহামারি নিয়ে রাজনীতি করা থেকে সবাইকে বিরত থাকা উচিত। সাধারণ মানুষের উচিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কথায় আস্থা রাখা। এর বাইরে এই টিকা নিয়ে যারা রাজনৈতিক কথা বলছেন তাদের কথায় গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নাই। ভ্যাকসিন না নেওয়ার বা ভ্যাকসিন-বিরোধী প্রোপাগান্ডা যারা চালাচ্ছেন, তারা দেশ ও দেশের মানুষের বড় রকমের ক্ষতি করছেন কিনা ভেবে দেখবেন। রাজনীতি আর করোনা টিকা এক করে ফেলা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয় না।
[ লেখক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক,
মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন ]
E-mail : gmbhuiyan@gmail.com