এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
বছর দেড়েক আগে নিশুর বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। সাড়ে তিন বছরের নিশু’কে তাকে নানির কাছে রেখে মা নতুন সংসার শুরু করেছে। নানি তার নাতনী নিশু রহমানকে তত্ত¡াবধান চেয়ে ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের বিধান অনুযায়ী মামলা দায়ের করেন। নিশুর পিতা আব্দুর রহমান তাঁর সন্তানের অধিকার চেয়ে এ অধ্যাদেশের ১৬-ক ধারায় আদালতে নিশুর অভিভাবকত্ব চেয়ে পাল্টাপাল্টি মামলা করেন। পারিবারিক আদালত শুনানী শেষে নিশুর নানীর করা মামলাটি খারিজ করে দেন। পিতা আব্দুর রহমানের করা মামলায় আদালত নিশুকে তার বাবার কাছে থাকার আদেশ দেন। শিশু নিশুর নানি এর বিরুদ্ধে আপিল করেন। আপিলে জেলা জজ আদালতও নিশুকে তার বাবার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ বহাল রাখেন।
মুসলিম আইনে বাবা হলেন সন্তানের স্বাভাবিক আইনগত অভিভাবক। মুসলিম আইনে মা সন্তানের অভিভাবক হতে পারেন না। তবে মা ৭ বছর বয়স পর্যন্ত পুত্র সন্তানকে ও বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত কন্যা সন্তানকে কাছে রাখতে পারেন। এ অধিকারকে বলে ‘হিজানা’ বা জিম্মাদারিত্ব। কিন্তু মা কখনই সন্তানের স্বাভাবিক অভিভাবক হতে পারেন না। এখানে একটি ব্যাপার উল্লেখ্য যে, সন্তানরা অন্য নারী আত্মীয়ের যতেœ বড় হয়ে উঠলেও সন্তানের ওপর বাবার সার্বিক তত্ত¡াবধান থেকেই যায়। মা তালাক হওয়ার কারণে সন্তানের জিম্মাদারিত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন না। কিন্তু মা দ্বিতীয় বিবাহ করলে সন্তানের জিম্মাদারিত্বের অগ্রাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। (১ বিসিআর, ২১)। তবে সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় যদি কোনো একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ওই সন্তানের ওপর মায়ের অভিভাবকত্ব যথার্থ বিবেচিত হয় তা হলে আদালত মাকে ওই সন্তানের অভিভাবক নিয়োগ করতে পারেন। (১০ বিএলটি ৩২৭)। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিবাহ করলেই মা সন্তানের ওপর জিম্মাদারিত্ব হারান না। তবে স্বামী-স্ত্রী যখন বসবাস করেন, তখন সন্তান তাদের কাছেই থাকবে। একত্রে বসবাসের সময় স্বামী যেমন কোনোক্রমেই স্ত্রীর কাছ থেকে সন্তানকে সরিয়ে নিতে পারেন না, তেমনি স্ত্রীও নাবালক সন্তানের জিম্মাদারিত্বের অধিকার সত্তে¡ও স্বামীর অনুমতি ছাড়া সন্তানকে সরিয়ে নিতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে ‘ইমামবন্দি বনাম মুসাদ্দির’ মামলায় বলা হয়েছে, ‘মুসলিম আইনে সন্তানের শরীরের ব্যাপারে লিঙ্গভেদে কিছু বয়স পর্যন্ত মা তত্ত¡াবধানের অধিকারিনী। মা স্বাভাবিক অভিভাবক নন। একমাত্র পিতাই বা যদি তিনি মৃত হন তাঁর নির্বাহক আইনগত বা বৈধ অভিভাবক।’ তবে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করলে মা এ অধিকার হারাবেন। [হেদায় ১৩৮, বেইলি ৪৩৫] সস্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব সম্পূর্ণ বাবার। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে ক্ষেত্রে অবশ্য মায়ের দ্বিতীয় স্বামী সন্তানের রক্ত সর্ম্পকীয় নিষিদ্ধ স্তরের মধ্যে একজন না হলে মা তার তত্ত¡াবধানের ক্ষমতা হারাবেন [২২ ডিএলআর ৬০৮]।
তবে যদি আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, সন্তান মায়ের হেফাজতে থাকলে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক হবে, সন্তানের কল্যাণ হবে এবং স্বার্থ রক্ষা হবে- সেক্ষেত্রে আদালত মাকে ওই বয়সের পরেও সন্তানের জিম্মাদার নিয়োগ করতে পারেন। আবু বকর সিদ্দিকী বনাম এস এম এ বকর ৩৮ ডিএলআরের মামলায় এই নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আপিল আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়, নাবালিকার হেফাজত পাওয়ার জন্য নানি ও বাবা উভয়ই আবেদন করেছেন। নিম্ন আদালত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন,‘মুসলিম আইন অনুযায়ী পিতা যে কোনো নাবালকের ন্যাচারাল গার্ডিয়ান (স্বাভাবিক অভিভাবক)। যেহেতু নাবালিকার মা দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন, সেহেতু পিতার ওপর অভিভাবকত্বের হেফাজত বর্তাইবে। তাই নাবালিকার নানির আনা আবেদন নাকচ করেন নিম্ন আদালত।’ রায়ে আরও বলা হয়, ‘পিতা-মাতা জীবিত থাকাকালে মুসলিম পারিবারিক আইন ও অভিভাবকত্ব আইনে অন্য কেউ নাবালিকার অধিকার পেতে পারে না। পিতা-মাতার অবর্তমানে নানি, এরপর দাদা-দাদি নাবালকের হেফাজত পাওয়ার অধিকারী। কিন্তু নাবালিকা নিশুর মা দ্বিতীয় বিবাহ করার কারণে নানির হেফাজতের অধিকার নষ্ট হয়েছে। পিতা দ্বিতীয় বিবাহ করেন নাই। পিতার পিতা-মাতা জীবিত আছে। কাজেই পিতার কাছে নাবালিকার অকল্যাণ হওয়ার কারণ নেই।’
নাবালকের কল্যাণের বিষয়টি হচ্ছে মূল কথা। আদালত নাবালকের কল্যাণ কীভাবে নিহিত আছে, সেটিই বিবেচনা করবেন। কোনো বাবা নিজের অচরণের কারণে সন্তানের তত্ত¡াবধানের অধিকার হারাতে পারেন। কোনো বাবা সন্তানের ভরণপোষণ দিতে অপারগ থাকলে সে ক্ষেত্রে বাবাকে মায়ের কাছ থেকে অধিকার সমর্পন করা ঠিক নয়। আবার মা যদি তাঁর নাবালক সন্তানের তাঁর স্বামীর আর্থিক সাহায্য ছাড়াই নিজ খরচে লালন-পালন করে থাকেন, তবে সে সন্তানকে আদালত বাবার তত্ত¡াবধানে দিতে অস্বীকার করতে পারেন। [১৭ ডিএলআর ১৩৪]। যদি কোনো নাবালকের কেউ না থাকে, আদালত নিজ বিবেচনায় অভিভাবক নিয়োগ করেন। ১৮৯০ এর অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইনের ধারানুযায়ী, নাবালিকা স্ত্রীর হেফাজত বা অভিভাবক তাঁর স্বামী।
নিচের যে কোনো এক বা একাধিক কারণে মা এই অধিকার হারাবেন:
১. নীতিহীন জীবনযাপন করলে,
২. যদি এমন কারো সঙ্গে তার বিয়ে হয় যিনি শিশুটির নিষিদ্ধ স্তরের মধ্যে ঘটলে তার ওই অধিকার পুনর্জীবিত হয়,
৩. সন্তানের প্রতি অবহেলা করলে ও দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে,
৪. বিয়ে থাকা অবস্থায় বাবার বসবাসস্থল থেকে দূরে বসবাস করলে,
৫. যদি সে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করে,
৬. যদি সন্তানের পিতাকে তার জিম্মায় থাকা অবস্থায় দেখতে না দেয়।
তবে আদালতের আদেশ ছাড়া সন্তানের জিম্মাদারের অধিকার থেকে মাকে বঞ্চিত করা যায় না। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, ১৬ ডিএলআরের জোহরা বেগম বনাম মাইমুনা খাতুন মামলায় আদালত বলেন, নিষিদ্ধ স্তরের বাইরে মায়ের বিয়ে হলেই মায়ের কাছ থেকে হেফাজতের অধিকার চলে যাবে না। মা যদি তার নতুন সংসারে সন্তানকে হেফাজতে রাখতে পারেন, সেক্ষেত্রে তাকে সন্তানের জিম্মাদারি দিতে কোনো সমস্যা নেই।
মা ছাড়া অন্য যারা নাবালকের জিম্মাদারিত্বের অধিকার লাভ করতে পারেন-
যখন কোনো নাবালকের মা মারা যান বা কোনো কারণে নাবালকের জিম্মাদারিত্বের অধিকার হারিয়ে ফেলেন সে ক্ষেত্রে নিচের মহিলা আত্মীয়রা জিম্মাদারের দায়িত্ব পাবেন। ১. মায়ের মা, যত ওপরের দিকে হোক (যেমন- নানি, নানির মা প্রমুখ), ২. বাবার মা, যত ওপরের দিকে হোক (যেমন- দাদি, দাদির মা প্রমুখ), ৩. পূর্ণ বোন (বাবা-মা একই), ৪. বৈপিত্রেয় বোন, ৫. পূর্ণ বোনের কন্যা, যত নিচের দিকে হোক, ৬. বৈপিত্রেয় বোনের কন্যা, যত নিচের দিকে হোক, ৭. পূর্ণ খালা, যত ওপরের দিকে হোক, ৮. বৈপিত্রেয় খালা, যত ওপরের দিকে হোক, ৯. পূর্ণ ফুফু (বাবার আপন বোন)। উপরোল্লিখিত মহিলারা না থাকলে নাবালকের যারা অভিভাবক হতে পারেন, তারা জিম্মাদারিত্বের অধিকার পাবেন। অর্থাৎ ১. বাবা, ২. নিকটতম দাদা, ৩. পূর্ণ ভাই (যাদের বাবা-মা এক), ৪. পূর্ণ ভাইয়ের ছেলে, ৫. রক্ত সম্পর্কীয় ভাইয়ের ছেলে, ৬. উত্তরাধিকারে বাবার বংশের সমান শ্রেণীভুক্ত অন্যান্য আত্মীয়, যেমন- চাচা।
সন্তানের অভিভাবক কে হবেন:
মুসলিম আইন অনুযায়ী মা যদিও স্বাভাবিক অভিভাবক নন, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অভিভাবকত্বের আবেদন করতে পারেন, যেমন- মা যদি দেখেন সন্তানের প্রকৃত অভিভাবক যিনি, তিনি ঠিকমতো দেখাশোনা করছেন না বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন তবে মা নিজ সন্তানের প্রকৃত কল্যাণের জন্য তার কাছে সন্তান থাকা উচিত মর্মে অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আবেদন করতে পারেন। ছেলে সন্তানের ৭ বছর পূর্ণ হলে এবং কন্যা সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছলে নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা অভিভাবকত্বের অধিকার পেতে পারেন। ১. বাবা, ২. বাবা কর্তৃক সম্পাদিত উইলে সন্তানের অভিভাবকত্ব যে ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে, ৩. বাবার বাবা যত ওপরেই হোক, ৪. আপন ভাই, ৫. রক্ত সম্পর্কের ভাই, ৬. আপন ভাইয়ের ছেলে, ৭. রক্ত সম্পর্কীয় ভাইয়ের ছেলে, ৮. বাবার আপন ভাইয়ের ছেলে, ৯. বাবার রক্ত সম্পর্কীয় ভাইয়ের ছেলে। যে ক্ষেত্রে এ রকম কোনো আত্মীয়ও নেই, সে ক্ষেত্রে আদালত তার স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতাবলে যে কাউকে নাবালক, নির্বোধ, উন্মাদ বা অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তির অভিভাবক নিয়োগ করতে পারে।
আদালত কেন অভিভাবক নিয়োগ করবেনঃ
যদি কোনো নাবালকের স্বাভাবিক অভিভাবক থেকে থাকে, তবে আদালতের মাধ্যমে অভিভাবক নিয়োগের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে স্বাভাবিক অভিভাবক তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে বা স্বাভাবিক অভিভাবকের মৃত্যু হলে অভিভাবকত্বের অধিকার নিয়ে মা-বাবা বা দাদা বা নানি-বাবার মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে ও সন্তানের অভিভাবকত্ব দাবি করে একাধিক আবেদনপত্র জমা হলে আদালত সমগ্র পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ শেষে নাবালকের কল্যাণের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত ব্যক্তিকে অভিভাবক নিয়োগ করবে। সন্তানের সম্পত্তির অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইন ৩ ধরনের অভিভাবকত্ব স্বীকার করে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন বিশ্লেষক, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮