হাবিবুর রহমান
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের মরন থাবা যেন থামছেনা বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশও এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে এ বছরের মার্চের শুরুর দিকে। হোম কোয়ারেন্টাইন বা সামাজিক দূরত্ব ব্যবস্থার আলোকে মহামারী ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ কল্পে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ২৫ মার্চ,২০২০ থেকে ২৫ এপ্রিল, ২০২০ পর্যন্ত টানা ৩২ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। সাধারণ ছুটিতে দেশজুড়ে একধরনের লকডাউন চলছে। স্থবির হয়ে পড়ছে অর্থনীতির চাকা, থমকে গেছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ইতোমধ্যেই সরকার বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কয়েক দফায় ঘোষিত প্রণোদনা ভাতার মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা যা জিডিপির ৩.৩ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবেই এই অর্থনৈতিক প্রণোদনা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন জাগছে জন মনে।
প্রথম প্রশ্ন হল, সরকার প্রণোদনার অর্থ জোগান দিবে কোথা থেকে?যেহেতু ব্যাংক থেকে ঋণ দিয়ে এই প্রণোদনা অর্থায়ন করা হবে, সেহেতু দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে পুন:ভরণ করতে হবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক Repo interest rate & CRR কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহের কাছে নগদ অর্থ বৃদ্ধি পাবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ অর্থের বাধ্যতামূলক জমা হ্রাস পাবে। এক কথায় বলতে গেলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তারল্য সংকট থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেতে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এ প্রচেষ্টা বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তারল্য সংকট কতটুকু কমাতে পারবে সেখানেও একটা বড় প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ বর্তমান ব্যাংক ব্যবস্থায় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে ব্যাংকের তরল সম্পদের পরিমাণে অনেকটাই ভাটা পড়েছে।
প্রণোদনার অর্থ যোগানের একটি বড় খাত হতে পারত রাজস্ব আয়। কিন্তু বর্তমানে শিল্প-কলকারখানা বন্ধ, বাজার ব্যবস্থা অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ার কারণে পণ্য বেচাকেনার ফলে ভ্যাট খাত থেকে রাজস্ব আয় অনেকটাই বন্ধ। অপরপক্ষে সরকারি ব্যয় খাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের অর্থ যোগানের অন্যতম বড় উপায় ট্রেজারি বিল-বন্ড বিক্রয়, সঞ্চয়পত্র বিক্রয়, ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড বিক্রয়, ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড বিক্রয় ও ডলার প্রিমিয়াম বন্ড বিক্রয়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ উৎস কতটুকু কার্যকর হবে? মানুষের আয় বৃদ্ধি পেলে সঞ্চয়ের একটা অংশ সরকারি খাতে ইনভেস্ট করবে এবং সেটা হবে সরকারের অর্থ যোগানের উৎস। সরকার ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড এবং ডলার প্রিমিয়াম বন্ড বিক্রি করে শুধু প্রবাসীদের কাছে।
কিন্তু বর্তমানে রেমিটেন্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। ফলে প্রবাসীগণ উক্ত বন্ড সমূহ কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করবে না এটাই স্বাভাবিক। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থ যোগান হলে সরকার অবশ্যই বৈদেশিক উৎসের কথা চিন্তা করবে। ইতোমধ্যে সরকার ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং আইএমএফ এর সাথে অর্থ যোগানের বিষয়ে যোগাযোগ করে। যেহেতু বৈশ্বিক অর্থনীতি ক্রমহ্রাসমান ফলে বৈদেশিক অনুদান আশা করা যায় না। সর্বোপরি অতিরিক্ত প্রণোদনার অর্থ যোগানের জন্য সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত সকল প্রণোদনাই কিন্তু বাজারভিত্তিক। কোন প্রকার ত্রাণ বা অনুদান হিসেবে সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করেননি। বরং সরকার প্রণোদনার মাধ্যমে সুদের বিনিময়ে বিনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের ব্যাংক থেকে উক্ত অর্থ ঋণ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। ইতোমধ্যে অর্থ বন্টনের নিমিত্তে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি নির্দেশনামূলক সার্কুলার জারি করেছে।বরাবরের মতই বাংলাদেশ ব্যাংক একটি পরিচ্ছন্ন সার্কুলার জারি করেছে।
ঋণ ব্যবস্থাপনায় সার্কুলার জারির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকে যতটা পারদর্শী মনে হয় ঋণ মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে তারা ঠিক ততটাই অপটু। প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে ঋণ বিতরণ ও আদায়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। খটকা তো এখানেই।এই প্রতিষ্ঠান গুলোর ভিক্তি এতই দুর্বল যে বিভিন্ন অনিয়ম বা প্রতিবন্ধকতার দরুন এরা ঋণ পাওয়ার প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে থাকবে।
পক্ষান্তরে এগিয়ে থাকবে বাহুবলে পারদর্শী, সরকারি পৃষ্ঠপোষক কিছু নামধারী শিল্প প্রতিষ্ঠান যাদের বিরুদ্ধে ঋণখেলাপির অভিযোগ রয়েছে। এটাতো অতীতে আমরা বহুবার দেখেছি।আইনের ফাঁকফোকর কিংবা ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা এর জন্য বহুলাংশে দায়ী। নির্দেশনায় স্পষ্ট বর্ণনা আছে যে ঋণ বিতরণ হবে ব্যাংক-ক্লায়েন্ট সম্পর্কের উপর নির্ভর করে। যেখানে ব্যাংক ও ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের ইচ্ছাই প্রাধান্য পাবে। বিভিন্ন ব্যাংক ও ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের ঋণ বিতরণের অনিয়মের প্রমাণ অনেক আছে।
সুতরাং সংশয় জাগে করোনা ভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত আসল ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গুলো সময়মতো ঋণ পাবে তো? ঋণ বিতরণে অনিয়ম রোধ ও ঋণ আদায় যথাযোগ্য ব্যবস্থা না থাকলে এমন অর্থনৈতিক প্রণোদনা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না বলেই অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের কাছে প্রতীয়মান হয়। নতুন বছরের শুরুতে ঘুচে যাক সকল অনিয়ম, টিকে থাক আমাদের অর্থনীতি। নববর্ষে বাঙালি জাতির প্রার্থনা হোক করোনা নামক মহামারী দূর হয়ে জনজীবনে স্বাভাবিকতা ফিরে আসুক।
লেখকঃ হাবিবুর রহমান, সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
মতামত লেখকের সম্পূর্ণই ব্যক্তিগত।