অ্যাডভোকেট বেল্লাল হোসাইন
মানসিক চাপ সামলানো কঠিন, ভীষণ কঠিন। কিন্তু এই চাপ সামলানোর জন্য প্রথম পদক্ষেপ নিজেকেই নিতে হয়। মনে রাখতে হবে, যেসব লোকেরা আমাদের নিজেদের জীবনে প্রভাব ফেলে, তাদের দিক থেকেই কষ্টদায়ক আচরণ বেশি আসে। তাহলে বিপদে কে-ইবা পাশে থাকলো? মানুষ সামাজিক জীব কেবল আনন্দ আর হৈ-হুল্লোড় করার সময়। কিন্তু কান্নাটা একাই কাঁদতে হয়। তাই একা একাই চোঁখ মুছতে জানতে হয়।
আজকের আলোচনাটা একটু ভিন্নভাবে শুরু করা যাক। আব্রাহাম মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্বটি সহজ কথায় আগে দেখে নেই। মাসলো মানুষের পাঁচ ধরণের প্রয়োজনকে দুই শ্রেণীতে ভাগ করেছেন।
ক) প্রাথমিক বা নিম্ন শ্রেণীর প্রয়োজন ক.১. দৈহিক বা মৌলিক চাহিদা ক.২. নিরাপত্তার চাহিদা
খ) উচ্চ শ্রেণীর প্রয়োজন খ.১. প্রতিপত্তি ও প্রীতির চাহিদা খ.২. আত্মমর্যাদার চাহিদা খ.৩. আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা চাহিদা সোপান তত্ত্বের সর্বনিম্ন চাহিদা- দৈহিক বা মৌলিক চাহিদা এবং চাহিদা সোপান তত্ত্বের সর্বোচ্চ চাহিদা- আত্মপ্রতিষ্ঠার চাহিদা।
২. বাংলাদেশের যুবসমাজ এখন চাহিদার সর্বোচ্চ স্তর পূরণের লক্ষ্যে না বলে, যদি বিলাসিতায় নেমেছে বলা হয়, তা অত্যুক্তি হবেনা মনে হয়। ভাত কাপড়ের অভাব কেটেছে। পোলাও কোর্মায় রুচি হারিয়েছি। তাই এখন আমরা ফ্রাইড রাইসের রং নিয়ে ব্যস্ত সবাই। এই অশুভ মিছিলের অগ্রভাগে দুর্ভাগ্যজনকভাবে যারা এগিয়ে আছে তাঁরা হলো সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর লোকেরা। অন্যের ভালোটা হজম করার মতো হজমশক্তি না থাকার ফলে কেউ কিছু একটা অর্জন করলে সেটা নিজেকেও জিততে হবে মানসিকতার জন্য দিনশেষে নিজেকেই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এই অশান্ত প্রতিযোগিতার পালে হাওয়া দিচ্ছে আমাদের প্রিয়জনেরাই। আত্মীয়, অনাত্মীয়, প্রতিবেশী, পরিচিত সবার একই বুলি,” তোমাকে আরো ভালো জায়গায় দেখতে চাই!” এই ভালো জায়গার মানদণ্ড যে কে নির্ধারণ করে দিলো, সেই গ্রুন্ডনর্ম খুঁজে বের করা কঠিন। তথাকথিত ভালো অবস্থানের খোঁজে আমাদের তারুণ্যের বুকফাটা আর্তনাদ আর অস্থির দৌড়ঝাপ দেখে আমাদের জীবন তাই পালাই পালাই করে। নিজের মগজের জোর থাকুক আর না থাকুক টপার আমাদের হতেই হবে। ব্যস! হয়ে গেলো। ছোটবেলা থেকে তুলনা আর তুলনা। ও পারে, তুই পারিস না, তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, না পারলে ঘরে আসবি না ইত্যাদি সব কুবচন শুনতে শুনতে বাচ্চারা যেন সবাই ল্যাং মারা শিখতে শিখতেই বড় হচ্ছে। সামর্থ্যের চেয়ে বেশি প্রেশার নিতে যেয়ে ব্যর্থতা যখন অবধারিত হয়ে যায়, তখন লোকের বিশেষ করে আপনজনদের বাজে কথা যাতে শুনতে না হয় সেজন্য অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
৩. সাইকোলজি টুডে আত্মহত্যার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন যার মধ্যে হতাশা, দুশ্চিন্তা, ব্যর্থতা আবেগের তাড়না, সহযোগিতা না পাওয়া, মনঃকষ্ট ও চলার পথের ভুল সিদ্ধান্তগুলোকে দায়ী করেন। বাংলাদেশীদের আত্মহত্যার আরেকটি বড় কারণ শিরিন-ফরহাত,লাইলি-মজনুর অনুপ্রেরণা অর্থাৎ প্রেমে ব্যর্থতা! একবার ভাবুন তো ওই উল্লেখিত কারণগুলোর কী এতটা শক্তিশালী হবার কথা যা মরে যেতে বাধ্য করে? আর্থিক সংকট নিজেকে ছোট ভাবার সবচেয়ে বড় কারণ। আমি মনে করি ইগোটা কমিয়ে যেকোন কাজের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে পারলে কর্মহীন থাকার সম্ভাবনা থাকে না। সবাইকে দিয়ে সব হবে না এই প্রাকৃতিক সত্যকে যতদিন পর্যন্ত নিজে ও কাছের স্বজনের কাছে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত ও বিশ্বাসযোগ্য করা যাবে না, ততদিন এই অকাল মৃত্যুর মিছিল শেষ হবে না। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা চলুক। এতে বাধা নেই। কিন্তু ব্যর্থ হলে সব শেষ, এই ধারণা থেকে বের হয়ে নিজের কাজকে ভালোবাসার বোধ জেগে উঠুক, এই বোধ ছড়িয়ে পড়ুক। অন্যকে সম্মান করার মাধ্যমে নিজের সম্মান অর্জন করি। সকলের কাজকে শ্রদ্ধা করে মমতার সমাজ গড়ি। দেশপ্রেমের ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে সেবামুখী দেশ গড়ি।
৪. আরে ভাই, নিজের একটি পেট তো! সেটা সামান্য পরিশ্রম করলেই চলে যায়। যে পরিবারকে সুরক্ষা দিতে এত প্রেশার নেয়া, মরে যাওয়া; আপনি মরে যাবার পর তাঁরা কী হীরা-জহরত পাবে একবার ভাবুন? আপনি নিজে ভালোভাবে বেঁচে থাকলে আপনার দায়িত্ব কর্তব্যের ব্যাপার সামনে আসবে। আপনার নিজের টিকে থাকতে কষ্ট হলে, অন্যদের সাহায্য করা আপনার দায়ের মধ্যে পরে না। বেশি দায়িত্বশীল হতে যেয়ে নিজে চিৎপটাং হলে ক্ষতিটা বেশি, এটা বুঝতে হবে। মুরুব্বিরা দয়া করে এবার চাই চাই বন্ধ করুন। স্নেহের পাশাপাশি সন্তানগুলোকেও কিছুটা সম্মান করার সময় এলো বৈকি।
৫. এতকিছুর পরও আত্মহত্যা প্রতিরোধে সামাজিক দায় পুরোপুরি এড়ানো যায় না। মৃত্যুর মতো করুণ বাস্তবকে যারা আলিঙ্গন করছে তাদের দুঃখবোধ আমাদের বুঝতে হবে। সামাজিক ন্যায্যতা ও সমতার অভাবে মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পরতে পারে। তাই সমস্যার মূলে ভাবতে হবে। এছাড়া নিজের মধ্যে কিছু গুনাবলি লালন করতে হবে। স্বাভাবিক-সাধারণ জীবনযাপন করুন, লোভ সামলান, অন্যের ভালো কাজের স্বীকৃতি দেন, পরিশ্রম করুন, যেকোন কাজকে শ্রদ্ধা করুন, জীবনকে ভালোবেসে জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখুন। ইতিবাচক চিন্তা করুন, ইতিবাচক বন্ধুদের সাথে মিশুন। সম্পর্কগুলোকে মর্যাদা দিন, স্বার্থপরতা ছাড়ুন। নিজের ও অন্যের ভালোভাবে বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরি করুন। ” কোনো অভিযোগ নয়, কোনো তুলনা নয় ” শান্তিতে বাঁচার জন্যে এরচেয়ে বড় মূলমন্ত্র আর নাই। আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন এর সূরা আন-আম এর ৪২ নম্বর আয়াতে বলেন, ” তারপর আমি তাদের উপর রোগব্যাধি, অভাব, দারিদ্র্য, ক্ষুধা চাপিয়ে দিয়েছিলাম, যেন তারা আমার কাছে নম্রতাসহ নতি স্বীকার করে। ” তাই ধৈর্য ধরতেই হবে।
বলা যায়, আমাদের কষ্টগুলো আমাদের জন্য পরীক্ষার জটিল প্রশ্নমালা! লেটার মার্কস না পেলেও, লিখে গেলে পাশ করার সম্ভাবনা আছে। তাই হাল ছাড়ার সুযোগ নেই প্রিয়। বেঁচে থাকুক আশা, বেঁচে থাকুক জীবন। বেঁচে থাকুক স্বপ্ন পূরণের অদ্ভূত দিবাস্বপ্নগুলো! স্রষ্টা সবাইকে সুস্থায়ু দান করুন।
লেখকঃ আইন কর্মকর্তা, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড। তিনি কলামিস্ট, প্রতিষ্ঠাতা সংগঠকঃ ” আমাদের স্বপ্ন ” ও আন্তঃপেশাজীবী সম্প্রীতি সমিতি bellal.sincere@gmail.com