জিনাত জাহান
জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি নি:সন্দেহে ইন্টাররিলেটেড। যেকোন মহামারীই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ইকোনমিকে অ্যাফেক্ট করে। নজির স্বরুপ ১৯১৮ এর স্প্যানিশ ফ্লু এর কথাই বলি। সে সময় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ইকোনমি চাহিদা ও সরবরাহ- দু’দিক থেকেই ধাক্কা খেয়েছিল। ‘করোনা ও অর্থনীতি’ এ বিষয়টি নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ইকনমিকস এর খ্যাতনামা অধ্যাপক আলব্রেশ্ট রিচেল এর অপিনিয়ন বেশ এলার্মিং। তার মতে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ১৯৩০ এর দশকের শুরুতে গ্লোবাল ইকোনমি যে ক্রাইসিসটা ফেইস করেছিল, করোনা উত্তর সময়ে ঠিক এমনটাই আবার ফেইস করবে। বর্তমান গ্লোবাল ইকোনমির হাল শুধুমাত্র বিশ্ব যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের ইকোনমির সাথেই মিলে, এমনটাই মনে করেন তিনি।
অর্থনীতির একটা বেসিক তালিম হচ্ছে, মানুষের হাতে টাকার কমতি থাকলে বাজারে চাহিদা কমবে। আবার বাজারে চাহিদা কমলে উৎপাদন শিল্প মার খেতে বাধ্য। উৎপাদন শিল্প মার খেলে কর্মি ছাটাই অবশ্যম্ভাবী। এই সবগুলো আলটিমেটলি আনএম্প্লয়মেন্ট এর রেইটকে হাই করবে।
করোনায় আমাদের ইকোনমি যে মেজর প্রব্লেমটি ফেইস করা শুরু করেছে সেটি হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও উৎপাদন ব্যাহত হওয়া। অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক ‘লক ডাউন’ এর কন্সিকুয়েন্স এটি। এখানে লস এর একটা নজির দেই। গার্মেন্টস খাতে ইতোমধ্যে ২৫০০০ কোটি টাকার ক্রয় আদেশ বাতিল হয়েছে। আমাদের প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি ফরেইন রেমিট্যান্স। করোনা এ খাতটিকে খুব প্যাথেটিক্যালি টাচ করবে। কৃষি খাত ফুড সাপ্লাই এর যে চেইনটা নিরবচ্ছিন্নভাবে মেইনটেইন করে যাচ্ছে, তা বড় ধাক্কা খাবে। শ্রমঘন শিল্পের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় একটা বড় অংশের মানুষের রুটি-রুজি অাজ হুমকির মুখে।
এবার চলুন একটা জরিপের রেজাল্ট দেখি। উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক গত ৩১ মাচ’ থেকে ০৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৪ জেলায় ২৬৭৫ জন নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে একটা জরিপ চালিয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া এই ২৬৭৫ জনের করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে গড় আয় ছিল ১৪৫৯৯ টাকা আর করোনা প্রাদুর্ভাবের পর তাদের আয় নেমেছে ৩৭৪২ টাকায়। তাদের পারিবারিক আয় গড়ে ৭৫ শতাংশের মত কমেছে। সবচেয়ে প্যাথেটিক দিক হচ্ছে, জরিপে অংশ নেয়া ১৪ ভাগ লোকের ঘরে কোন খাবার নেই আর ২৯ ভাগ মানুষের ঘরে আছে ০১-০৩ দিনের খাবার।
এবার চলুন দাগ থেকে দারুন কিছু হওয়ার গল্প শুনি। অর্থনৈতিক সংকট সমাজে আবার বেশ কিছু বড় পরিবর্তনও নিয়ে আসে। যেমন ধরুন প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের কথা। বলা বাহুল্য, এ সময় অর্থনীতি বড় মাপের ধাক্কা খেয়েছিল। তারপরও প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পর নারীদের কর্মসংস্থানের হার বেড়েছে; ট্রেড ইউনিয়ন স্বীকৃতি পেয়েছে আর দিনে আট ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারিত হয়েছে।সিমিলারলি,দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর শিল্প পণ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে অার বেড়েছে সমাজে ভোক্তার সংখ্যা । ইতোমধ্যে, চলমান করোনা সংকট আমাদের কাজের ধরণে পরিবর্তন এনেছে। সারা বিশ্বব্যাপী অনেক ক্ষেত্রেই ঘরে বসে অফিস করা এর একটা উদাহরণ ।
এবার দেখি বিশ্ব অর্থনীতির মোড়লেরা কোন্ তরীকা অ্যাডপ্ট করেছে? যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের ‘ডিস্কাউন্ট উইন্ডো’ ব্যাবহার করে এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে। ইউরোপে সেন্ট্রাল ব্যাংক তাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য কম সুদে লোন সরবরাহ করছে। যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ইকোনমিতে পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সুদের হার কমিয়েছে। বিশ্ব যুদ্ধের সময়গুলোতে জার্মানি যে টেকনিকে এমন ক্রাইসিসের সাথে ফাইট করেছিল, এবারো সেই ‘শট’ টাইম ওয়ার্ক’ এর টেকনিক এপ্লাই করা শুরু করেছে। তবে অর্থনৈতিক ইতিহাসের খ্যাতনামা অধ্যাপক আলব্রেশ্ট রিচেল আশংকা করেন যে, এই সবগুলো তরিকাই বিশ্বজুড়ে একটা ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতির জন্য দায়ী হতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে এ পরিস্থিতি মোকাবিলার লক্ষ্যে প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সরকার খাতভিত্তিক পরিকল্পনা নিয়েছে। দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করি অতীতের অনেক সংকটের মত এ সংকটও কাটিয়ে উঠতে আমরা সক্ষম হব।
লেখকঃ জিনাত জাহান, সহকারি জজ
মতামত ব্যক্তিগত