মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব।
বর্তমান সময়ে COVID-19 একটি বৈশ্বিক সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। গোটা বিশ্বে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যেমন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে সাথে সাথে অসংখ্য মানুষ হারাচ্ছে প্রাণ। বাংলাদেশেও সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যেহেতু এখন পর্যন্ত এর কোন প্রতিষেধক আবিস্কৃত হয়নি ফলে সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করাই এর বিস্তারে কার্যকর উপায়। আমাদের দেশে সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় লক ডাউন সহ কঠোর আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এরপরও জনগনের উদাসীনতা এবং অসচেতনতা চোখে পরার মত। বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো যেখানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে আমাদের দেশে অবস্থা কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা হয়ত আমরা এখনো বুঝতে সক্ষম হইনি।
অনেকেই সরকারের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, কেন বিদেশ ফেরতদের এয়ারপোর্ট থেকেই আলাদা করা হল না অথবা কিট, পিপিই কেন প্রথম থেকেই পর্যাপ্ত হারে প্রদান করা হল না, কেন বেশি সংখ্যক পরীক্ষার জন্য প্রথমেই ল্যাব বসানো হল না। কেউ কেউ আবার চাচ্ছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রীর মত পদক্ষেপ। কিন্তু আগে কানাডার নাগরিক হবার চেষ্টা কি আমরা করেছি!
সরকার ছুটি ঘোষনার পর লঞ্চঘাটে,রেলস্টেশনে,বাস টার্মিনালে আমরা যেভাবে “স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার” টাইটেল ট্রাকের সাথে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরেছি তাতে নিজেরা কতটা অসচেতনতার পরিচয় দিয়েছি তার হিসাব কে করবে। ট্রাকে, কাভার্ড ভ্যানে করে পর্যন্ত মানুষ ফিরেছে দলে দলে। মাঠে পুলিশ,সেনাবাহিনী থাকার পরও তাদের সাথে লুকোচুরি খেলছি, ইচ্ছামত ঘুরে বেড়াচ্ছি, চা-পান খেয়ে বেড়াচ্ছি, দোকানের সাটার নামিয়ে রেখে গায়েবি আওয়াজ তুলে বাজার করছি, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল দল দেখলে দৌড় আবার তারা সরে গেলে দল বেঁধে অলিগলিতে আড্ডা দিচ্ছি তা সত্যি অবস্থা আরও ভয়াবহ করে তুলছে।
লোক মুখে গল্প প্রচলিত আছে, “মানুষ প্রকাশ্য ফাঁসির অনুষ্ঠান অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েও পকেট মারের কবলে পরেছে।” এমন ঘটনাও নেহায়েত কম নয়। শুধু করোনা নয়, বরং বিভিন্ন সময়েই নিয়ম কানুন বা আইন মানার প্রতি আমাদের তীব্র অনিহা। প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ আইন মানছে না কেন। এই নিয়ম বা আইন না মানার পেছনে অনেক কারণ আছে। একটা দেশের সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষার হার, সামাজিক মূল্যবোধ, দারিদ্রতা, অপরিকল্পিত নগরায়ন যেমন কারণ হিসেবে বিবেচিত তেমনি মৌলিক অধিকারের যথাযথ প্রয়োগ, সরকারের জবাবদিহিতা, আইনের অনুশাসন, গণতন্ত্র, দুর্নীতি, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, নাগরিক অধিকার, ভোটাধিকার সহ সামগ্রিক বিষয় জড়িত।
সাংবিধানিক আইনের ভাষায় যাকে বলে Constitutionalism. একটা দেশের Constitutionalism যতটা শক্তপোক্ত সে দেশে আইন মান্য করার হারও ভাল।
সরকার বা রাষ্ট্রের ক্ষমতা যে অসীম নয়, বরং সংবিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ, ইচ্ছা করলেই সরকার তাদের নিজেদের কথা মত রাষ্ট্র পরিচালিত করতে পারে না, এই ধারনাই মূলত Constitutionalism.
প্রখ্যাত আইনবিদ Pofessor S.A. De Smith তাঁর “The Commonwealth and It’s Constitution” বইয়ের Constitutionalism এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন “Where the government is genuinely accountable to an entity or organ distinct from itself, where elections are freely held on a wide franchise at frequent intervals, where political groups are free to organize in opposition to the government in office and where there are effective legal guarantees of fundamental civil liberties enforced by an independent judiciary.”
De Smith এর ভাষায়, এই নীতির চারটি মৌলিক দিক রয়েছে। যথাঃ
১। সরকার সত্যিকার অর্থে জনগণের নিকট জবাবদিহিতা করতে দায়বদ্ধ থাকবে।
২। জনগণের ভোটে প্রতিযোগিতামূলক অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
৩। রাজনৈতিক দলগুলো অবাধে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে এবং সরকারের সমালোচনা করতে পারবে।
৪। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ তাদের মৌলিক অধিকারগুলোর নিশ্চয়তা পাবে।
প্রথিতযশা আইনবিদ Louis Henkin বিষয়টাকে আর একটু বড় করে
দেখেছেন। তিনি তাঁর Foreign Affairs and the U.S. Constitution বইতে
Constitutionalism এর উপাদান হিসেবে ৯ টি বিষয় উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলঃ
১। সরকার সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হবে,
২। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ ( Separation of Power),
৩। জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং গণতান্ত্রিক সরকার,
৪। সাংবিধানিক পর্যালোচনা (Constitutional Review),
৫। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা,
৬। ব্যক্তি অধিকারের ক্ষেত্রে সরকারের সীমাবদ্ধ হস্তক্ষেপ,
৭। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ,
৮। সামরিক বাহিনীর সিভিলিয়ান নিয়ন্ত্রণ,
৯। সংবিধানের বিধান নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের সীমিত ক্ষমতা।
আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোর দিকে নজর দিলে আমরা বুঝতে পারবো এই সকল বিষয়গুলো আমরা কতটা অর্জন করতে পেরেছি।
Criminology বা অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষায় মানুষের অপরাধ করার প্রবনতার পেছনে নানা জৈবিক, সামাজিক,ভৌগলিক কারণ থাকে। তবে সেগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকার কতটা Constitutionalism নীতি প্রয়োগ করতে পারছে সেটাও কম গুরুত্ববহন করে না।
যেসকল দেশে সংবিধান এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা যত কঠোরভাবে
অনুসরন করা হয়, সেসব দেশে আইন ব্যবস্থা ততই সুস্থ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র
ব্যবস্থায় সাংবিধানিক বিধিবিধান যথাযথ পালনের মাধ্যমে সরকার জনকল্যাণ মূলক
আইন প্রণয়ন দ্বারা
নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, দেশের জনগণের নিকট জবাবদিহিতা
নিশ্চিত করা, বিচারবিভাগ তথা সমগ্র প্রশাসনিক কাঠামো যখন স্বাধীন ও
নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করার মাধ্যমে রাষ্ট্রকাঠামো দেশের জনগনের আস্থা বৃদ্ধি
যত করতে পারবে, জনগণও আইনের প্রতি ততটাই শ্রদ্ধাশীল হবে।
মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ্ আল-গালিব।
এল এল.বি (অনার্স) এল এল. এম
শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।