বিল্লাল বিন কাশেম
করোনার এই মহামারীতেও প্রতিদিন সকালে নিয়মমাফিক ঘুম থেকে উঠে সকালের নাস্তা, দুপুরে কয়েক আইটেম দিয়ে লাঞ্চ, রাতে সবার সাথে ডিনার চলছে আমাদের। লক ডাউন/ আইসোলেশনে থেকেও আমরা ভালো আছি বলতে হবে। কিন্তু একবারও কি আমরা ভাবছি রিকশাওয়ালা, দিনমজুর বা শ্রমজীবী মানুষদের কথা? সমাজের খেটে-খাওয়া এই মানুষগুলো কিভাবে সংকটময় পরিস্থিতিতে তাদের পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিবেন? এখনই সময় এই মেহনতী মানুষগুলোর পাশে দাড়ানোর। তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রত্যকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসলেই এ সংকটময় পরিস্থিতি থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি আসবে! চলুন না সবাই মিলে এই মানুষগুলোর পাশে দাড়াই! তাদের প্রতি আমাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই!
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোক গণনার তথ্যসূত্রে, দেশে মোট বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯ শত ৩৫টি। বস্তিবাসী ও ভাসমান খানা রয়েছে ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮ শত ৬১টি। এর মধ্যে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় রয়েছে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৭ শত ৫৬টি। এ শুমারিতে বস্তিবাসীর সংখ্যা ৬ লাখ উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে এ সংখ্যা আরো বেশি হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা প্রতিরোধে বস্তিবাসীকে বাদ দিয়েই কাজ করা হচ্ছে। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তাদের জন্য এখনো দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ সাধারণের চেয়ে বস্তিবাসী ও ছিন্নমূল মানুষের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এসব মানুষকে সুরক্ষার আওতায় আনতে হলে তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, করোনা সম্পর্কে সচেতন হওয়ার জন্য যে ন্যূনতম শিক্ষা প্রয়োজন, তা বস্তিবাসীর নেই। আবার গণমাধ্যমগুলোয় করোনাভাইরাসের জন্য প্রচারিত সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন যে বস্তিবাসীর মধ্যে সবাই দেখেন, এমন নয়। এখনো বস্তিবাসীকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি এনজিও সংস্থাগুলো। আশঙ্কাজনক হলেও এটি সত্য, বস্তিবাসীর মধ্যে করোনার উপসর্গ দেখা দিলেও তারা এ ভাইরাস পরীক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে ফোন দেবেন না। আবার বস্তিবাসীর নমুনা সংগ্রহ করতে কেউ বস্তিতেও যাবেন না। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরই বস্তিগুলোয় গিয়ে কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কি না তা দেখতে হবে। প্রয়োজনে আক্রান্ত ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে আনতে হবে। বিষয়টি এখন জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
সংক্রমণ বিস্তার রোধে সারাদেশে গত ২৬ মার্চ থেকে লক ডাউন শুরু হয়েছে। তাই এই লক ডাউনে নিম্ন আয়ের মানুষ অর্থ ও সঞ্চয় সংকটে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। শুরুতেই সঞ্চয়হীন ভাসমান মানুষ, দিনমজুর, অসহায় বৃদ্ধ-অনাথ-এতিম, রিকশা চালক, ছোট কারখানা, নির্মাণ শ্রমিক যারা দিন আনে দিন খায় তারাই চরম সংকটে পড়বে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারনা। লক ডাউনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই আয় করতে না পারার কারণে খাদ্য সংকটে পড়বেন বলেই অর্থনীতিবিদের ধারনা।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের মোট শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৮ লাখ। যার মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রাক্কলন করেছে যে, অন্তত নয় লাখ লোক আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মহীন হবে। অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মে নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ বা ৫ কোটি ১৭ লাখ ৩৪ হাজার। শ্রম অধিকার প্রায় বঞ্চিত বিশাল শ্রমশক্তির অধিকাংশই কাজ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। করোনা আতঙ্কে বন্ধ হয়ে গেছে ৮৭ দশমিক শিল্পকারখানা। দেশের ছয়টি শিল্প–অধ্যুষিত এলাকার সব খাত মিলিয়ে শিল্পকারখানা আছে ৭ হাজার ৪ শত ০৮টি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, এর মধ্যে ৬ হাজার ৪ শত ২৩টি বা ৮৭ শতাংশ শিল্পকারখানাই বন্ধ হয়ে গেছে। দারিদ্র্য ও অতি দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে সাড়ে ২০ ও সাড়ে ১০ শতাংশ (চার কোটি)। তাই পারিবারিক আয়হীন স্থায়ী বেকার, অনানুষ্ঠানিক খাতের অর্ধেক মিলে অন্তত সাড়ে ৬ কোটি মানুষের জন্য এপ্রিলের প্রথম, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই খাদ্য সরবরাহ লাগতে পারে। তিন মাস জরুরি খাদ্য সরবরাহ করতে লাগে অন্তত কুড়ি হাজার কোটি টাকা।
এ বিষয়গুলো মাথায় না রাখলে দেশে অপরাধের বিস্তার ঘটবে। নাগরিক অসন্তোষে দীর্ঘ মেয়াদে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়ে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে সংকট তৈরি করবে বলেও মত বিশেষজ্ঞদের। আর দীর্ঘ মেয়াদে এ ক্ষতি আরো বেশি হবে বলেও তাদের মত। এক্ষেত্রে ইতিহাসে তেলের মূল্যহ্রাসের সর্ববৃহৎ পতনে ব্যারেলপ্রতি মাত্র ২০ ডলার, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিলে ছাড় দিয়ে মানুষের সঞ্চয়ের মেয়াদ কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব। এভাবে বাসাভাড়ায় সাময়িক ছাড় দিলেও সঞ্চয় দীর্ঘায়িত হবে। এতে ক্ষুদ্রশিল্পেরও উপকার হবে। সেক্ষত্রে বাড়ি মালিকদের প্রণোদনাও দেয়া যেতে পারে।
শহরের ভাসমান মানুষগুলোর কোথাও থেকে রোজগার করতে পারছেনা। আবার তারা ঋণ করতেও পারবে না সে কারণে তাদের জন্য খাদ্যসংকট অবধারিত। গ্রাম এলাকায় কৃষি ও ক্ষুদ্রশিল্পভিত্তিক ‘উৎপাদনব্যবস্থা’ এখনো বিদ্যমান থাকায় সেখানে খাদ্যসংকট কিছুটা দেরিতে আসবে। তবে গ্রামে ভাসমান মানুষদের কাজ না থাকায় তৃতীয় কিংবা চতুর্থ সপ্তাহ থেকে খাদ্যসংকট শুরু হতে পারে।
এর পরেই আসছে কর্মহীন নিম্নবিত্ত শ্রেণী। যাদের কিছু জমা টাকা ও খোরপোশ ছিল এমন শ্রেণি। এর পরে আসবে বেতন বন্ধ হয়ে সঞ্চয় ফুরিয়ে যাওয়া নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তও। এই সব কটি প্রান্তিক ধারার জন্য জরুরি খাদ্য সরবরাহ করার একটা দায় আছে। এসব মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পরিবার ভিত্তিক চাল, তেল সাবান, পয়াজ, মরিচ রেশন দেয়া যেতে পারে। এসব মানুষের খাদ্য সরবরাহ করতে হয়তো সাত হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন পড়বে। ইতিমধ্যে সরকার পাঁচ হাকার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এক্ষেত্রে সরকার ও আমাদের বেসরকারি সেক্টরের শিল্পপতিরা এগিয়ে আসলে আরো সহজতর হবে। সমন্বিত পরিকল্পনায় সামনে এগুলে সামনের সংকট মোকাবেলা করা সহজ হবে।
এ বিষয়গুলো মাথায় না রাখলে দেশে অপরাধের বিস্তার ঘটবে। নাগরিক অসন্তোষে দীর্ঘ মেয়াদে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়ে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে সংকট তৈরি করবে বলেও মত বিশেষজ্ঞদের। আর দীর্ঘ মেয়াদে এ ক্ষতি আরো বেশি হবে বলেও তাদের মত। এক্ষেত্রে ইতিহাসে তেলের মূল্যহ্রাসের সর্ববৃহৎ পতনে ব্যারেলপ্রতি মাত্র ২০ ডলার, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিলে ছাড় দিয়ে মানুষের সঞ্চয়ের মেয়াদ কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব। এভাবে বাসাভাড়ায় সাময়িক ছাড় দিলেও সঞ্চয় দীর্ঘায়িত হবে। এতে ক্ষুদ্রশিল্পেরও উপকার হবে। সেক্ষত্রে বাড়ি মালিকদের প্রণোদনাও দেয়া যেতে পারে।
শহরের ভাসমান মানুষগুলোর কোথাও থেকে রোজগার করতে পারছেনা। আবার তারা ঋণ করতেও পারবে না সে কারণে তাদের জন্য খাদ্যসংকট অবধারিত। গ্রাম এলাকায় কৃষি ও ক্ষুদ্রশিল্পভিত্তিক ‘উৎপাদনব্যবস্থা’ এখনো বিদ্যমান থাকায় সেখানে খাদ্যসংকট কিছুটা দেরিতে আসবে। তবে গ্রামে ভাসমান মানুষদের কাজ না থাকায় তৃতীয় কিংবা চতুর্থ সপ্তাহ থেকে খাদ্যসংকট শুরু হতে পারে।
এর পরেই আসছে কর্মহীন নিম্নবিত্ত শ্রেণী। যাদের কিছু জমা টাকা ও খোরপোশ ছিল এমন শ্রেণি। এর পরে আসবে বেতন বন্ধ হয়ে সঞ্চয় ফুরিয়ে যাওয়া নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তও। এই সব কটি প্রান্তিক ধারার জন্য জরুরি খাদ্য সরবরাহ করার একটা দায় আছে। এসব মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পরিবার ভিত্তিক চাল, তেল সাবান, পয়াজ, মরিচ রেশন দেয়া যেতে পারে। এসব মানুষের খাদ্য সরবরাহ করতে হয়তো সাত হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন পড়বে। ইতিমধ্যে সরকার পাঁচ হাকার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এক্ষেত্রে সরকার ও আমাদের বেসরকারি সেক্টরের শিল্পপতিরা এগিয়ে আসলে আরো সহজতর হবে। সমন্বিত পরিকল্পনায় সামনে এগুলে সামনের সংকট মোকাবেলা করা সহজ হবে।
এদিকে, আমাদের পাশের পশ্চিমবঙ্গ সরকার সাত কোটি মানুষের ছয় মাসের জরুরি খাদ্য সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে কেরালার সরকার কুড়ি হাজার কোটি রুপির করোনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, এসেছে বিদ্যুৎ বিলে ছাড়ের ঘোষণা। বাংলাদেশেও মাথাপিছু ন্যূনতম ‘ক্যালরি ধারণ’ ভিত্তিতে ভাসমান প্রান্তিক শ্রেণি, স্থায়ী বেকার, তাৎক্ষণিকভাবে কাজহীন, বেতন বন্ধ হয়ে পড়া, সঞ্চয় ফুরিয়ে যাওয়া শ্রেণির জন্য খাদ্য সরবরাহের বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। আর্থিক সংখ্যায় রূপান্তর করলে দেখা সরকারের জন্য তৈরি হয়েছে বড় এক আর্থিক বোঝা! বৈদেশিক সাহায্য আর দেশীয় এলিটরা এগিয়ে এলে এটি কোন সমস্যাই না বলে বিশ্বাস করি।
তবে এটিও না বল্লেই নয় যে, শুধুমাত্র সরবরাহ ১০ টাকা চালের মধ্যে সীমিত রাখলে চলবে না। এজন্য বেশি ক্যালরি সম্পন্ন চাল-ডাল-গম-লবণ-ভোজ্য তেল ইত্যাদিতে জরুরি খাদ্য সরবরাহ আরো বিস্তৃত করতে হবে। করোনার পরেই ‘ঘরে ফেরা’ কর্মসূচি শেষে অলস শ্রমের যে ঘনীভবন হবে, তার শ্রমবাজার গন্তব্য নিয়েও আগে থেকে ভাবনায় রাখতে হবে। করোনার এই সংকট মোকাবিলায় শরীরিক দূরত্ব মানে এই নয় আমাদের সামাজিকভাবে সব কিছু বয়কট করতে হবে। বাঙালির চিরন্তন যে ঐতিহ্য পারস্পরিক সৌহার্দ্য -সেটা এই সংকটে আরো বাড়বে-বৈ কমবে না।
বিল্লাল বিন কাশেম
কবি, লেখক ও গল্পকার।
bellalbinquashem@gmail.com