ফাইজুল্লাহ ফয়েজ
জামিন শব্দের অর্থ হলো জিম্মা, ইংরেজীতে বলে বেইল, বাংলাদেশের মানুষের কাছে অতিপরিচিত শব্দ জামিন, আমি যখন পরিচয় দেই যে আমি আইনজীবী বেশিরভাগ বন্ধু বান্ধব বলে উঠবে আমার জামিন করিয়ে দিস।
অথচ জামিন একটি মামলার অতি সামান্য অংশ, একটি মামলার অনেকগুলো স্টেজের মধ্যে জামিন একটি।
কিন্তু বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো এই জামিনের পেছনে বিচারিক কর্মঘন্টার অধিকাংশ সময় ব্যয় হয়।
কমন ল কান্ট্রির বেশিরভাগ দেশে এই জামিন দেয় পুলিশ, অথচ বাংলাদেশে সামান্য ১১গ এর মামলার জামিন নিতে হাইকোর্টে আসা লাগে, হাইকোর্টের অত্যন্ত দক্ষ ও মেধাবী বিচারপতি কে সপ্তাহে তিন দিন শুধু জামিন সংক্রান্ত বিষয় শুনতে সময় ব্যয় করতে হয়, তারপরও অনেক মাননীয় বিচারপতি কে সপ্তাহে চার দিন ই জামিনের পেছনে ব্যয় করতে হয়।
অথচ গুরুত্বপূর্ণ আপিল, ডেথ রেফারেন্স, রিট, সিভিল রিভিশন, ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৬১এ ধারার আবেদন, ফৌজদারী রিভিশন সহ কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যেখানে আইনের চর্চার এবং নতুন নতুন আইনি বিশ্লেষণের অবাধ সুযোগ।
অন্য দেশে যেখানে পুলিশ জামিন দেয় সর্বোচ্চ ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত আসে জামিনের বিষয়ে, সেখানে আমাদের দেশে আগাম জামিন পেতে হাইকোর্টে আসতে হয়, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের যেখানে আইনগতভাবে থেকো আসামিকে ই জামিন দেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সেখানে মৌখিক আইন দিয়ে হত্যা মামলা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা, বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা সহ বেশ কিছু মামলায় জামিন দিতে নিষেধ করা হয়ে থাকে।
২০০৭ সালের পর থেকে বাংলাদেশের আইন পড়া সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা বিচারক হিসেবে জয়েন করে ম্যাজিস্ট্রেট বা জজ হিসেবে কর্মরত আছেন, তাদের যথেষ্ট দক্ষতা আছে কোন মামলায় জামিন দেয়া যাবে কোন মামলায় দেয়া যাবে না, অথচ উপর থেকে তাদের কে চাপে রেখে ইন্ডিপেন্ডেন্স অব জুডিশিয়ারি লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
কোন কোন বিচারক আবার নিজ থেকে চাপ অনুভব করে এফআইআরকে ই সত্য মনে করে আসামিকে জেল হাজতে প্রেরণ করাই মহান দায়িত্ব মনে করেন।
জামিন দেন কাস্টডি পিরিয়ড হিসেব করে, কতটুকু পরিমাণ মাদকদ্রব্য বা নিষিদ্ধ দ্রব্য আসামির কাছে পাওয়ার অভিযোগ তা হিসাব করে।
সুযোগ বুঝে নিরীহ মানুষ কে মাদকদ্রব্য দিয়ে ফাঁসানো অনেক বেড়ে গেছে, এখন প্রতিটি থানায় ভালো করে সার্চ করলে হয়তো মাদক দ্রব্য রক্ষিত পাওয়া যাবে, যেটা দিয়ে নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা হয়।
বাংলাদেশের আইনের দাদা বৃটিশরা যেখানে জামিন কে করেছেন স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে, কারো জামিন নামঞ্জুর করতে হলে প্রসিকিউশন কে যথেষ্ট এভিডেন্স দেখাতে হবে যে এই আসামিকে জামিন দিলে ভিক্টিম আক্রান্ত হতে পারে, তদন্তকাজ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, পালিয়ে যাবে বা হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার।
অথচ আমাদের দেশে জামিন না হওয়া স্বাভাবিক, একজন আসামি কোর্টে নিয়মিত হাজিরা দিয়েও জামিন বাতিলের শিকার হন, হাইকোর্টকে আবার এসংক্রান্ত নির্দেশনা দিতে হয়।
আগাম জামিন দেয়ার পরেও ভিক্টিম পক্ষ থেকে অপব্যবহারের কোন অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোর্টে হাজির হওয়া সত্ত্বেও কোন ধরনের যৌক্তিক গ্রাউন্ড উল্লেখ না করেই জামিন নামঞ্জুর করে ই চলেছেন বাংলাদেশের মাননীয় বিচারকগণ।
অথচ এই জামিন হলো আসামিকে আইনের আওতায় আনার একটি পদ্ধতি মাত্র, স্বেচ্ছায় আত্নসমর্পন করা দরিদ্র, ক্ষমতাসীন একটা ব্যক্তিকে জেলহাজতে যে পাঠালেন এই লোকটি এক বছর, দুই বছর বিনাবিচারে জেল খেটে যখন খালাস পেলেন, তখন তাকে আপনি কি ক্ষতিপূরণ দিতে পারছেন?
তার শোকে হয়তো মারা যাওয়া বা কার্যত অচল হয়ে যাওয়া মা বাবা কে ফিরিয়ে দিতে পারবেন?
তার সন্তানের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়ে যাওয়া টা কি ক্ষতিপূরণ দিয়ে মেকাপ হবে?
অথচ তাকে জামিন দিলে ঠিক ই হাজির হতেন, ট্রায়ালে কোন ক্ষতি হতো না, কিন্তু আপনারা দিচ্ছেন না, কারন জামিনের স্পিরিট ভুলে গিয়ে উকিলরা যেমন জামিন কে ই তার ওকালতির সবকিছু মনে করছেন, জজ সাহেবরাও তেমনি জামিন দেয়া না দেয়া নিয়ে জীবন পার করছেন।
মানুষজন জামিন কে ই খালাসের মতো মনে করছেন, জীবন যেন জামিনময়।