মৌলিক অধিকার হলো একগুচ্ছ অধিকারের সমষ্টি যা ছাড়া মানুষের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ ও নাগরিক জীবনের যথার্থ উপলব্ধি করতে পারেন না।সমগ্র বিশ্বের মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে জন্য যে সকল অধিকার দরকার সেগুলোকে মানবাধিকার বলে গন্য করা হয়।মানবাধিকার হলো সার্বজনীন অধিকার।মানবাধিকারসমূহ যখন কোন দেশের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ও আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য হয় তখন উক্ত অধিকারসমূহকে মৌলিক অধিকার বলা হয়।মৌলিক অধিকারসমূহ অবশ্যই সাংবিধানিক নিশ্চয়তা দ্বারা সংরক্ষণ করা হয়।অর্থাৎ সকল মৌলিক অধিকার মানবাধিকার কিন্তু সকল মানবাধিকার মৌলিক অধিকার নয়।
পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সভ্য রাষ্ট্র নাগরিকদের পূর্ণ বিকাশের জন্য মৌলিক অধিকারের বিধান সংবিধানে সন্নিবেশিত করেছে।অনেক আগেই মৌলিক মানবাধিকারের ধারনটি মানব মনে দানা বাধতে শুরু করে।ম্যাগনা কার্টা ১২১৫, পিটিশন অব রাইটস ১৬২৮ ও বিল অব রাইটস ১৬৮৮ ইত্যাদির মাধ্যমে মানবাধিকার ধারনাটির আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করে।
আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের বিধানগুলো প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকার যেগুলো মূলতঃ সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র,১৯৪৮ থেকে গ্রহন করা হয়েছে।এই ভাগের বিধানগুলো সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত এবং বলবৎযোগ্য তাই আমরা মৌলিক অধিকার বলে থাকি।
সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের বিশেষত্ব হলো,নির্বাহী বিভাগের কোন আদেশ বা সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন দ্বারা মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে আদালতের মাধ্যমে বলবৎ করা যায়।যেমন-অনুচ্ছেদ-২৬ এ বলা হয়েছে,রাষ্ট্র মৌলিক অধিকার পরিপন্থি কোন আইন প্রনয়ন করবে না এবং এরূপ কোন আইন প্রনয়ন করলে যতটুকু সংবিধানের সাথে অসংগতি ততটুকু বাতিল বলে গন্য হবে।অর্থাৎ উচ্চ আদালত হলো মৌলিক অধিকারের অভিভাবক।রাষ্ট্র যদি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি কোন আইন প্রনয়ন করে সেক্ষেত্রে আদালত বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনা(judicial review)এর মাধ্যমে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে।
বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায় মৌলিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।এই অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ ২৭ থেকে ৪৪ পর্যন্ত মোট ১৮টি মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।অনুচ্ছেদ ৩২,৩৩,৩৪,৩৫,৪১ ও ৪৪ -এ বর্ণিত মৌলিক অধিকার সমূহ রাষ্ট্রের সকল নাগরিক ও বিদেশীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।অন্যদিকে অনুচ্ছেদ ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪২, ৪৩ শুধু মাত্র রাষ্ট্রের সকল নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য।
বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহ নিচে উল্লেখ করা হলো-
১. আইনের দৃষ্টিতে সমতা (অনুচ্ছেদ ২৭)
২. ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য (অনুচ্ছেদ ২৮)
৩. সরকারি নিয়োগলাভে সুযোগের সমতা
(অনুচ্ছেদ ২৯)
৪. বিদেশী উপাধি, সম্মান সম্পর্কীয় নিষেধাজ্ঞা ৷ (অনুচ্ছেদ ৩০)
৫. আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩১)
৬. জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার
(অনুচ্ছেদ ৩২)
৭. গ্রেফতার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ
(অনুচ্ছেদ ৩৩)
৮. জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ (অনুচ্ছেদ ৩৪)
৯. বিচার ও দন্ড সম্পর্কে রক্ষণ (অনুচ্ছেদ ৩৫)
১০. চলাফেরার স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ৩৬)
১১. সমাবেশের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ৩৭)
১২. সংগঠনের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ৩৮)
১৩. চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক-স্বাধীনতার (অনুচ্ছেদ ৩৯)
১৪. পেশা ও বৃত্তির স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ৪০)
১৫. ধর্মীয় স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ৪১)
১৬. সম্পত্তির অধিকার (অনুচ্ছেদ ৪২)
১৭. গৃহ ও যোগাযোগ রক্ষণ (অনুচ্ছেদ ৪৩)
১৮. সাংবিধানিক প্রতিকার পাওয়ার অধিকার (অনুচ্ছেদ ৪৪)
জনস্বার্থ,জনশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য কতিপয় মৌলিক অধিকারের উপর যুক্তি সংগত বাঁধা-নিষেধ আরোপ করা যায়।যেমন-চলাফেরার স্বাধীনতা(অনুচ্ছেদ ৩৬), সমাবেশের স্বাধীনতা(অনুচ্ছেদ ৩৭), সংগঠনের স্বাধীনতা(অনুচ্ছেদ ৩৮), বাক-স্বাধীনতার(অনুচ্ছেদ ৩৯(২)(ক)(খ), ধর্মীয় স্বাধীনতা(অনুচ্ছেদ ৪১) ও গৃহ ও যোগাযোগ রক্ষণ(অনুচ্ছেদ)
মৌলিক অধিকার হলো মানুষের অবিচ্ছেদ্য ও অলঙ্ঘনীয় অধিকার।মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে কিভাবে অধিকারসমূহ বলবৎ করতে হয় তা প্রতিটি দেশের সংবিধানে উল্লেখ আছে।এমনকি সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র ১৯৪৮ এর অনুচ্ছেদ-৮ বলা হয়েছে-“শাসনতন্ত্রে বা আইনে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত জাতীয় বিচার আদালতের কাছ থেকে কার্যকর প্রতিকার লাভের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে”।
মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে সাধারণত দুইভাবে বলবৎ করা যায়-
১. বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা মাধ্যমে
২. আদালতের মাধ্যমে
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা মাধ্যমে সাধারণত সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনের বৈধতা নির্ণয় করা হয়।সংসদ যদি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী কোন আইন প্রনয়ন করে যতটুকু সাংঘর্ষিক ততটুকু বাতিল বলে গন্য হবে।অর্থাৎ উচ্চ আদালত মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইনকে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে।
অন্যদিকে,শাসন বিভাগের অযাচিত হস্তক্ষেপ বা অন্যকোন কারনে যদি কারও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয় তখন যে কেউ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মামলা দায়ের করে তার অধিকার পুনরুদ্ধার করতে পারবে।
কারন সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,এই ভাগের অধিকারসমূহ বলবৎ করার জন্য ১০২ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মামলা রুজু করা যাবে এবং হাইকোর্ট বিভাগ সেক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনক্রমে মৌলিক অধিকার বলবৎ করা জন্য যে কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে আদেশ দিতে পারেন।
একটা সময় কোন ব্যক্তি প্রত্যক্ষভাবে সংক্ষুব্ধ হলে শুধুমাত্র মামলা করতে পারতো।আদালত ‘সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি’ শব্দটির ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে রক্ষনশীল মনোভাব পোষণ করে আসছিল যা ছিল জনস্বার্থের মামলার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা।বিভিন্ন কেসের মাধ্যমে ‘সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি’ ধারনাটি সম্প্রসারিত হয়।১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম [কাজী মুখলেছুর রহমান বনাম বাংলাদেশ, ২৬ ডি এল আর ১৯৭৪, (এডি) ৪৪] এই মামলায় সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা লোকাস স্ট্যান্ডাই সম্পর্কে প্রশ্ন উত্তাপিত হয়।এই আবেদনটি খারিজ হলেও সুপ্রীম কোর্ট আবেদনকারীর লোকাস স্ট্যান্ডাই স্বীকার করে মত পোষন করেন।
[মহিউদ্দিন ফারুক বনাম বাংলাদেশ ১৯৯৬] মামলায় আপীল বিভাগ কর্তৃক ‘সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি’ প্রশ্নের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা হয়।মামলায় আপীল বিভাগ বলেন- “সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি” কথাটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগতভাবে অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে বোঝায় না বরং এটা জনসাধারণ পর্যন্ত বিস্তৃত অর্থাৎ জোটবদ্ধ বা সমষ্টিগত ব্যক্তিত্বকে বোঝায়।
জনস্বার্থের মামলা ধারনা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে এমনকি সাংবিধানিক বিধান লঙ্ঘিত হলেও পরোক্ষভাবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মামলা করতে পারছে।
সুতরাং মৌলিক অধিকার হলো মানুষের আইনগত অধিকার।কারও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে হাইকোর্ট বিভাগে মামলা দায়ের করতে পারেন।এমনকি পরোক্ষভাবে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিও জনস্বার্থে মামলা দায়ের করতে পারেন।
যায়েদ বিন খলিল
শিক্ষার্থী,আইন বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়