শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদন্ড, উচ্চশিক্ষা তবে মেরুদন্ডের অস্থিমজ্জা। বিশ্ববিদ্যালয় যেগুলোকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে মূল্যায়ণ করা হয়, আমাদের দেশের সেসব বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সাথে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিস্তর ফারাক।
উচ্চশিক্ষা বলতে সাধারণত নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান সম্পন্ন, উন্নয়ন কাজে পারদর্শী দক্ষজনবল তৈরির জন্য যে শিক্ষা সেটাকে বোঝানো হয়। সেটা হতে পারে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ তৈরির শিক্ষা কিংবা অর্থনীতিবিদ, সাহিত্যিক, চিত্রকর তৈরির শিক্ষা কিংবা ধর্মীয় উচ্চশিক্ষা। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা বলতে যে আমাদের বৃহৎ অংশ শুধু বিজ্ঞানশিক্ষা কিংবা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার তৈরির শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, এইরূপ চিন্তাধারাও পরিবর্তন করা আবশ্যক। আবার উচ্চশিক্ষা শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডির মধ্যেই হবে এই চিন্তাধারাও পরিবর্তন করা উচিত।
আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থা বলতে আমরা সকল দেশ-মহাদেশ বিবেচনা না করে শুধু ইউরোপীয়, আমেরিকান, ফরাসী, চাইনিজ, জাপানিজ ইত্যাদি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা গুলোর দিকে বেশি নজর দেই। সে সকল দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে তাকালে কিছু বিষয় দেখা যায় যেগুলো আমাদের থেকে মোটামুটি পৃথক –
১. আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রযুক্তিনির্ভর বেশি, কিন্তু বাংলাদেশে প্রযুক্তির ব্যবহার তূলনামূলক কম।
২. বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয় গুলোর ক্ষেত্রে নতুন নতুন অমিমাংসিত, অনাবিষ্কৃত বিষয় নিয়ে পড়াশুনা বেশি, পুরনো আবিষ্কার এর নতুনোত্তর ব্যবহার, নতুন প্রযুক্তির আনয়ন, স্বল্প মূল্যে প্রযুক্তির উৎপাদন ইত্যাদি বিষয় বেশি আলোচিত। অপরদিকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়গুলোর সিলেবাস এ প্রথম ৩ বছর আদিমযুগের আবিষ্কার, সূত্র, প্রযুক্তি পড়ানো হয়ে থাকে তারপর পড়ানো হয় কি কি আবিষ্কার হয়নি/হওয়া বাকি। এর ফলে শিক্ষার্থীরা নতুন কিছু করার সুযোগ পায় না।
৩. ব্যবহারিক জ্ঞান এবং তাত্ত্বিকজ্ঞান এর আনুপাতিক ভারসাম্য সমন্বিত পাঠ্যসূচি যেকোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য অত্যন্ত জরুরি। আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির মূলমন্ত্র যেখানে ব্যবহারিক শিক্ষার ক্রেডিট আওয়ার বা পাঠ্যসময় বৃদ্ধি, সেখানে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় তাত্ত্বিক পড়াশোনায়। ফিল্ড ট্রেনিং, ল্যাব, জরিপ, বাংলা লোক-সাহিত্যের সমালোচনা, নতুন সাহিত্য বা উপন্যাস সৃষ্টির দিকে মন না দিয়ে বাংলাদেশে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জনসাধনের ফলে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা ভারী কঠিন হয়ে পড়েছে।
৪. উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবার চেয়ে চাকুরীতে যোগ্য হবার চেষ্টা আমাদের দেশে প্রবল। নিজের পড়াশুনার চেয়ে মূদ্রার নাম, দেশের নাম, রাজধানীর নাম, সংবিধান এসব মুখস্ত করে জলদি একটি চাকুরি পাবার প্রবণতার কারনে আমরা প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের গ্রাজুয়েট পাই ঠিকই, কিন্তু তাদেরকে স্ব-স্ব ফিল্ডের কাজে লাগাতে পারি না কিংবা সেটা করতে তারা পারদর্শী হয় না। এর থেকে উত্তোরনের উপায় হলো আমাদের চাকুরীর নির্বাচন পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন করা। যে মেডিক্যাল সাইন্স থেকে পাশ করে বিসিএস দিয়ে ডাক্তার হবে তার নিশ্চয়ই তথাকথিত “সাধারন জ্ঞান” শেখার চেয়ে রোগীর চিকিৎসাজ্ঞান অর্জন করা বেশি শ্রেয়; যে সাহিত্যে অনার্স করছে, তাকে নাসা কবে স্পুটনিক-২ পাঠিয়েছে এটা জিজ্ঞেস করে বিচার করতে পারি না।
৫. দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্রাক্ষ্মণনীতির প্রভাব থাকায় শিক্ষার্থীরা হীনমন্যতায় ভুগে এবং নিজের অধ্যয়নরত বিষয়ে মনোনিবেশ করতে পারে না। ফলশ্রুতিতে আমরা তাদের থেকে নতুন কিছু পাই না। ব্রাক্ষ্মণনীতি বলতে দেশে যারা ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার তারা উচ্চপর্যায়ের ব্রাক্ষ্মণ, তারপর বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা, তারপর কমার্স, তারপর আর্টস, এরপর ডিপ্লোমা। কিন্তু এভাবে চিন্তা করলে দেশের উন্নতি বা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি আশা করা সমিচীন নয়। প্রতিটি বিষয়, প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট কে সমান চোখে দেখে, সমান সুযোগ দিয়ে যদি আগানো যায় তাহলে ভালো কিছু করা সম্ভব।
৬. আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারি-সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বন্দ নেই। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রতিযোগীতা আছে তবে খারাপ প্রতিযোগীতা না, আবিষ্কার করার প্রতিযোগিতা। কিন্তু আমরা পড়ে থাকি প্রজেক্ট লাভের আশায়, বাজেট লাভের আশায়, রাজনীতির আশায় শুধু শিক্ষা-গবেষনা বাদে বাকি সবকিছুই ভালোভাবে বিদ্যমান। উচ্চশিক্ষায় রাজনীতির প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু রাজনীতিরও ‘নীতি’ থাকা আবশ্যক।
৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার চেয়ে বর্তমানে ডিপ্লোমাধারীরা বেশি শিখতে পারছে। ডিপ্লোমা কলেজগুলোর মত করে কারিগরি শিক্ষা আর তাত্ত্বিক শিক্ষা একসাথে করে সিলেবাস (ডিপ্লোমার চেয়ে বেশি পড়াশুনা থাকবে, বেশি গভীর জ্ঞান থাকবে) পরিবর্তন করা দরকার। অন্তত গায়ে এসির বাতাস লাগিয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া সম্ভব না, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে রাস্তাঘাট, দালান-কোঠার কাজে ঘাম ঝরানো দরকার। গান শুনে ফোকলোর চর্চা সম্ভব নয়, গ্রামগঞ্জে হেঁটে হেঁটে খুঁজে খুঁজে তবেই লোকগীতি আবিষ্কার করা সম্ভব।
৮. দেশের উচ্চশিক্ষার করুণ দশা হওয়ায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে যার অধিকাংশই প্রবাসে স্থায়ী হয়ে থেকে যান। কারণ তারা তাদের অর্জন অনুযায়ী যথাযথ মর্যাদাও দেশে পান না। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির বালাই নেই উপরন্তু মেধা পাচার হচ্ছে বলা চলে।
সর্বোপরি, আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থা ও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক উচ্চশিক্ষার মধ্যকার যে ব্যবধান রয়েছে তা সমাধানে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা আনয়ণ করা এখন সময়ের দাবী ; যা হবে উভয় শিক্ষাব্যবস্থার সমসত্ব সমন্বয়। তা নাহলে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা রেমিটেন্স ব্যতীত নিজের বিদ্যা ও বুদ্ধি দিয়ে স্বদেশের উন্নয়ন করতে পারবেনা।
লেখক : মোঃ শওকত আলম ফয়সাল
শিক্ষার্থী,
৩য় বর্ষ,
আইন বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল : shawkat786alam@gmail.com