তালহা জাহিদঃ আজ ৯ জিলহজ বৃহস্পতিবার পবিত্র হজ্ব অনুষ্ঠিত হবে। হাজীদের ‘উকুফে আরাফা’ বা আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিন। বিশ্ব মুসলিমের মহাসম্মেলনের দিন। যদিও এ বছর করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে মাত্র ১০ হাজার লোকের অংশগ্রহণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে হজ্ব পালিত হচ্ছে, যেখানে প্রতি বছর বিশ্বের ১৬০টির বেশি দেশের ২৫ লাখের হাজীর কণ্ঠে উচ্চারিত ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাশারিকালাকা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠত মক্কার আরাফার আকাশ বাতাস।
এক স্বর্গীয় আবহ সৃষ্টি হবে আজ মক্কার অদূরে আরাফার ময়দানে। সবার পরনে সাদা দুই খণ্ড বস্ত্র। সবার দীন বেশ। দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ, রহমত প্রাপ্তি ও নিজের গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে অশ্রুসিক্ত ফরিয়াদ জানাবেন সমবেত মুসলমানেরা। একে-অপরের সাথে পরিচিত হবেন, কুশল বিনিময় করবেন। সব হজযাত্রী ও বিশ্ব মুসলিমের জন্য প্রদান করা হবে খুতবা। যাতে থাকবে মুসলিম উম্মাহর জন্য দিকনির্দেশনা। বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এক অনুপম দৃশ্যেরও অবতারণা হবে আজ এই ময়দানে।
আজ জোহরের নামাজের ওয়াক্তের আগেই এ বছরের জন্য মনোনীত হজ্বযাত্রীদের সমবেত করা হবে মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ১০ কিলোমিটার বিস্তৃত ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে। ১৪০০ বছর আগে এই ময়দানেই রাসূল সা: লক্ষাধিক সাহাবিকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। এই ময়দানেই ইসলামের পরিপূর্ণতার ঘোষণা দিয়ে কুরআনের আয়াত নাজিল হয়েছিল।
হাজীরা আজ আরাফাতের প্রান্তরে অবস্থান করে সেখানে অবস্থিত মসজিদে নামিরাহ থেকে প্রদত্ত খুতবা শুনবেন এবং একসাথে জোহর ও আসরের নামাজ একই ইমামের পেছনে আদায় করবেন। সূর্যাস্তের পর ময়দান ত্যাগ করবেন। এ বছর হজের খুতবা দেবেন প্রখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞ শেখ আবদুল্লাহ বিন সুলাইমান আল মানিয়া (৮৯)।
এর আগে গতকাল হজযাত্রীদের বিশেষ ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাওয়াফে কুদুম করানো হয়। এরপরই মিনার তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হয়। মিনা থেকেই আজ সকালে হাজীদের আরাফাতের ময়দানে নিয়ে যাওয়া হবে।
৮ জিলহজ থেকে টানা পাঁচ দিন ধরে হজের আরো অনেক করণীয় থাকলেও আজ ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়াদানে অবস্থানের দিনকেই হজের দিন বলা হয়। সৌদি আরবের হিজরি মাস গণনা অনুযায়ী হজের কার্যাদি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন শুরু হয়েছে গতকাল ৮ জিলহজ বুধবার মিনার তাঁবুতে অবস্থানের মধ্য দিয়ে। মিনায় হাজীদের জন্য শীততাপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবু রয়েছে। পুরুষ ও মহিলাদের থাকার জন্য আলাদা তাঁবু রাখা হয়েছে পাশাপাশি। গতকাল মিনায় তালবিয়া, জিকির, নফল নামাজ, হজের মাসলা-মাসায়েল আলোচনার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করেন হাজীরা। আজ ফজরের নামাজের পর সূর্যোদয়ের পর থেকে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে হাজীদের রওনা হওয়ার নিয়ম। অন্যান্য বছর ভিড় এড়াতে হাজীরা আগের রাতেই আরাফাতের উদ্দেশে রওনা হতেন এবং সেখানে গিয়ে অস্থায়ী তাঁবুতে অবস্থা নেয়া শুরু করতেন। বাসে, হেঁটে হাজীরা আরাফায় পৌঁছান। বাকিরা হজের দিন সকালে মিনা থেকে সরাসরি আরাফার ময়দানে চলে যেতেন। এবার স্বল্পসংখ্যক হাজী হওয়ায় আজ সকালেই সবাইকে বিশেষ ব্যবস্থায় স্বাস্থ্যকর্মীদের তত্ত্বাবধানে আরাফার ময়দানে নিয়ে যাওয়া হবে। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যস্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হজের অন্যতম ফরজ। কেউ এই সময়ের মধ্যে এই ময়দানে অবস্থান করতে না পারলে হজ আদায় হবে না।
এই ময়দানে জোহরের সময় পরপর জোহর ও আসরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করবেন হাজীরা। মুসাফির হওয়ার কারণে নামাজ কসর করবেন (চার রাকাতের স্থলে দুই রাকাত)। নামাজের আগেই মসজিদে নামিরাহ থেকে খুতবা দেবেন নির্ধারিত খতিব। এর আগে পরে হজযাত্রীদের কণ্ঠে উচ্চারিত ‘লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত হবে পুরো ময়দান। আমির-ফকির, ধনী-গরিব, সাদা-কালোর ভেদাভেদ থাকবে না সেখানে। সবার পরনে একই ধরনের সেলাইবিহীন কাপড়, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ এবং তারই কাছে গুনাহ মাফ ও রহমত প্রাপ্তির আকুতি।
সূর্যাস্তের সাথে সাথেই আবার মিনায় ফেরার পথে মুজদালিফা নামক স্থানে রাতে অবস্থান নেবেন হাজীরা। ওই স্থানে রাতে অবস্থান করবেন খোলা আকাশের নিচে। সেখানে মাগরিব ও এশার নামাজ এক সাথে আদায় করবেন। মিনায় জামারাতে শয়তানের প্রতিকৃতিতে নিক্ষেপের জন্য এখান থেকেই কঙ্কর সংগ্রহ করার নিয়ম। তবে এবার আগেই হাজীদের জীবাণুমুক্ত পাথর সরবরাহ করা হয়েছে।
রাতে সেখানে অবস্থানের পর কাল ১০ জিলহজ শুক্রবার ফজরের নামাজ শেষে সূর্যাস্তের আগেই মিনার দিকে রওনা হবেন। কালই সৌদি আরবে ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। মিনায় গিয়ে জামারাতে বড় শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ এবং কোরবানি করবেন। মিনায় কোরবানি করার পর হাজীরা মাথা মুণ্ডন করে অথবা চুল ছোট করে ইহরাম ভেঙে ফেলবেন। এরপর তাওয়াফে জিয়ারাহ করার জন্য মক্কায় যাবেন। তাওয়াফ করে সেখানে হেরেম শরিফ সংলগ্ন সাফা-মারওয়া নামক পাহাড়দ্বয়ের মাঝে দৌঁড়াবেন (সায়ি করবেন)। জিলহজের ১১, ১২ জিলহজ মিনার তাঁবুতে অবস্থান করেই জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করার নিয়ম। ১২ জিলহজ হজের আনুষ্ঠানিক কার্যাদির সমাপ্তি ঘটবে। কেউ ১২ তারিখ মীনা ত্যাগ না করলে ১৩ তারিখও তাকে জামারাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। মিনার তাঁবুতে অবস্থান করেই পাঁচ দিনের হজের কার্যাদি সম্পন্ন করবেন হাজীরা।
আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা একজন হাজীর জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। হাজীরা এই দিনটিসহ পুরো হজকার্য সম্পাদনের জন্য আজীবন স্বপ্ন লালন করেন।
হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূল সা: বলেছেন, এমন কোনো দিবস নেই যেখানে আল্লাহতায়ালা আরাফা দিবস থেকে বেশি বান্দাহকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন এবং আল্লাহ নিশ্চয় নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেস্তাদের সাথে গর্ব করেন, বলেন, ওরা কী চায়? (মুসলিম)। আরেক হাদিসে এসেছে, আল্লাহ তায়ালা আরাফায় অবস্থানরতদের নিয়ে আকাশবাসীদের সাথে গর্ব করেন। তিনি বলেন, আমার বান্দাদের দিকে তাকিয়ে দেখ, তারা আমার কাছে এসেছে আলুথালু ও ধুলায় আবৃত অবস্থায়। (মুসনাদে আহমাদ)
আরাফাতের ময়দান দোয়া কবুলের জায়গা। এখানেই আদি পিতা আদম ও হাওয়া আ:-এর পুনর্মিলন হয়েছিল এবং তাদের দোয়া কবুল হয়েছিল মর্মে বর্ণনা পাওয়া যায়। এই ময়দান রাসূল সা:-এর বিদায় হজের ভাষণের স্মৃতিবিজড়িত। সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাজীরা গ্রুপে এবং আলাদা আলাদাভাবে দোয়া করতে থাকেন। দুই হাত উঁচু করে অঝোর ধারায় কান্নাকাটি করেন হাজীরা। গুনাহ মাফের আকুতি ছাড়াও জীবনের সব চাওয়াই আল্লাহর দরবারে পেশ করেন। সূর্যাস্তের পর আরাফার ময়দান ত্যাগের সময় নিজেকে নির্ভার-নিষ্পাপ জ্ঞান করে মুজদালিফার দিকে এগোতে থাকেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ছুটে যাওয়া মুসলমানরা।
হজরত আদম আ: কর্তৃক নির্মিত পৃথিবীর প্রথম ঘর কাবাকে কেন্দ্র করেই মূলত হজের কার্যাদি। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইব্রাহিম আ: ও তার ছেলে ইসমাঈল আ: এই কাবা ঘর পুনর্নির্মাণ করেন। হজের বেশির ভাগ কাজই হজরত ইব্রাহিম আ:, তার স্ত্রী হাজেরা এবং ছেলে ইসমাঈল আ:-এর সম্পাদিত কাজের সাথে সম্পর্কিত। মুসলমানরা পশু কোরবানি আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে ইব্রাহিম আ: কর্তৃক স্বীয় শিশুপুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি করতে যাওয়ার মহান ত্যাগের ঘটনার সাথে সম্পর্কিত। হজ ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম এবং সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ।
হিজরি মাস ঘটনায় সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের এক দিনের পার্থক্য রয়েছে। এই হিসেবে আজ সৌদি আরবে ৯ জিলহজ অর্থাৎ হজের দিন হলেও বাংলাদেশ আজ ৮ জিলহজ। বাংলাদেশে আগামী শনিবার ১০ জিলহজ পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। পশু কোরবানি করবেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।বিবিসি