বেল্লাল হোসাইন
অনেক দিন পর বিশ্ববাসী সবাই এক কাতারে শামিল হলেন। প্রথম বিশ্ব আর তৃতীয় বিশ্বের ফারাক ঘুচে গেছে নিজেদের অসহায়ত্বের কাছে। সভ্যতার বৈপ্লবিক আবিষ্কার চাকা আজ স্থবির, অচল। বিমান উড়ছে না, বুলেট ট্রেন চলছে না। এ যেন আবার আদিম যুগে ফিরে যাওয়া। প্রকৃতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করা আর নিজেদের খাপ খায়িয়ে টিকিয়ে রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা।
দুনিয়াব্যাপী মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘায়িত করছে করোনাভাইরাস। এ এক সর্বজনীন অসুখ। সুস্থ, অসুস্থ, বয়োবৃদ্ধ, শিশু, রাজা, প্রজা কাউকেই নিস্তার দিচ্ছে না কোভিড-১৯। আপনি ধনী কিংবা গরিব, আপনি দোর্দণ্ড প্রতাপশালী কিংবা সাধারণ মানুষ যা-ই হোন না কেন আপনাকে আলিঙ্গন করতে সর্বগ্রাসী সর্বজনীন মহামারি রোগ এসেছে। অথচ আমরা এই সময়েও পুঁজি বানাচ্ছি! মজুতদারি করে নিজেকে নিরাপদ ভাবছি। আমরা ঝগড়া করছি, একে অন্যকে দোষ দিচ্ছি। ‘আহারে মানুষ, কার জন্য রাখছ সম্পদ, করছ বাড়ি-গাড়ি, দুদিন বাদে সাদা কাফনে ছাড়তে হবে সবই।’
২.
ইতালি ও স্পেনের ভয়াবহ পরিণতির জন্য শুরুর দিকে তাদের গা–ছাড়া
ভাবকে দায়ী করা হচ্ছে। এখন তারা আফসোসও করছে। কিন্তু দেরির মাশুল গুনে শেষ
করা যাচ্ছে না। অথচ আমরা কী শিক্ষা নিচ্ছি। লোকজনকে জনসমাগমে নিরুৎসাহিত
করে অফিস–আদালত খোলা রেখে একটা প্যারাডক্স তৈরি করছি। কার্যকরভাবে
কোয়ারেন্টিন মানা হচ্ছে না। সরকার জনগণকে আর জনগণ সরকারকে দুষছে।
নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, এ মহামারি মোকাবিলা করার শক্তি রাষ্ট্রের একার নেই। তাই আসুন দোষারোপ বাদ দিয়ে নিজেরা কিছু অবদান রাখি। সবাই সবার জায়গা থেকে একটু ত্যাগ করলে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা হলেও হ্রাস করা যায়। রাজনৈতিক মতপার্থক্য–নির্বিশেষে সবাইকে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে একযোগে কাজ করতে হবে। জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে হবে। সচেতন হতে হবে। একটু কম কেনাকাটা, একটু কম ভোগবিলাস অন্যদের কিছুটা হলেও শান্তি দেবে। এ রোগ এমন যেখানে শুধু নিজে ভালো থাকা যাবে না। অন্যদের ভালো না রাখতে পারলে নিজেকে ভোগান্তিতে পড়তেই হবে। এ এক আজব পরীক্ষা। সাম্যের পরীক্ষা!
৩.
এ দুর্যোগে বাংলাদেশের আলেম সমাজের ভূমিকা রাখার সুবর্ণ সুযোগ।
বাংলাদেশের আপামর সাধারণ মানুষ ধর্মভীরুতার দরুন আলেম–ওলামাদের কথাকে
গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। লোকজন আলেমদের কথা বিশ্বাস করে ও শোনে। তাই তাদের
দিয়ে সঠিক তথ্য উপাত্ত তুলে ধরতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে ইসলাম আবির্ভাবের
সময়ের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মহামারির সময় কেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, সেসব
আলোচনা ভিডিও বার্তায় ছড়িয়ে দিতে হবে। এখনো মাহফিলে প্রচুর লোক সমাগম হয়।
ঝুঁকি এড়ানো যাচ্ছে না। কোনো সুযোগসন্ধানী নিজের আখের গোছাতে যেন ধর্মীয়
উন্মাদনা সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে সতর্ক থাকা চাই। এসব ধর্মীয় ইস্যুতে
সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করলে পরিস্থিতি নাজুক হবে। কাজেই আলেম সমাজকে
দায়িত্ব নিতেই হবে।
৪.
দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণরত এক সরকারি কর্মকর্তা সেখানে
করোনাভাইরাস মোকাবিলা করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেছেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়ায়
১১৮টি স্থানে করোনাভাইরাস পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কয়েক জায়গায়
তাঁবু টাঙিয়ে পরীক্ষা চলছে। এ কারণে প্রতিদিনই ২০ হাজারের বেশি পরীক্ষা
করতে পারছে দেশটি। এখানে একটি কোম্পানি SEGENE মাত্র চার ঘণ্টায়
করোনাভাইরাস টেস্টের কিট তৈরি করেছে। প্রতিটি কিট দিয়ে ১০০ জন মানুষের
পরীক্ষা করা যায়। ফলাফল দিতে মাত্র চার ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন হয়। প্রতিটি
টেস্টে খরচ পড়বে ২০ ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ৭০০ টাকা। এরা যে
মেশিনে টেস্ট করে সেটা রোবটিক হ্যান্ড। মানুষের স্পর্শ লাগে না। এ কারণে
টেস্টের সঙ্গে জড়িতরা নিরাপদ। কম খরচে পরীক্ষা করা যায় বলে কোরিয়া সবার
জন্য ফ্রি পরীক্ষা করতে পারছে। এটাই বিশ্বের লেটেস্ট প্রযুক্তি। কোরিয়া এ
কারণে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এগিয়ে গেছে। প্রায় আড়াই লাখ লোকের পরীক্ষা
করতে সমর্থ হয়েছে।’ বাংলাদেশের জন্য এই প্রযুক্তি অনুসন্ধানের তাগিদ দেন এই
কর্মকর্তা। অথচ আমরা গুটিকয়েক মানুষকে টেস্ট করে পরিসংখ্যান তুলে ধরছি।
৫.
দেশীয় চিকিৎসাব্যবস্থার টেকসই কাঠামো তৈরি করা দরকার। এখন কোনো
সম্পদশালী লোক, মন্ত্রী, সাংসদেরা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যেতে পারছেন না।
সাধারণ মানুষেরা সারা বছর দেশে কেমন চিকিৎসা সেবা পায়, তা এখন বাধ্য হয়ে
প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হচ্ছে তাদের। আশা করাই যায়, এবার অন্তত নিজেদের
সক্ষমতা বাড়াতে তাদের বোধোদয় হবে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা.
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান আবিষ্কৃত করোনাভাইরাস টেস্ট কিট দ্রুত সময়ের
মধ্যে বাজারজাত করে মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। পদ্ধতিটির উদ্ভাবক ড.
বিজন কুমার শীলকে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত। আবেগতাড়িতভাবে, বিবেকবর্জিত
হয়ে সবাইকে রাজনৈতিক বক্তব্য থেকে বিরত থাকতে হবে। বিভেদ না বাড়িয়ে কার্যকর
পদক্ষেপ নিতে সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে বলে দেশের মানুষ আশা করেন।
চীনের চিকিৎসা সহায়তার আগ্রহে বাংলাদেশ উপকার পাবে। ধর্ম-বর্ণ-জাতির পার্থক্য করার সময় এখন নয়। মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে ভালোবাসা আর মমত্ববোধেই এই বিশ্ব-সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। তাই আমাদের সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত হোক স্রষ্টার সৃষ্টির কল্যাণে। সমগ্র মানবজাতি আজ হুমকির মুখে। আপাতত সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, রাজনীতি, ভূরাজনীতি, বিশ্বব্যবস্থা, নয়া বিশ্বব্যবস্থা, মেরুকরণ, জি-৭, এলডিসি এসব আলোচনা বাদ থাক। শুধু থাকুক বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ আর সংকট মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য।
এপিএস নিউজ/সানজানা
সূত্র : প্রথম আলো অনলাইন