বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধে কঠোর হচ্ছে সরকার। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানি-রপ্তানি ও ভুয়া বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ পাচার প্রমাণ হলে ৫০ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা সংক্রান্ত আইন হালনাগাদ করা হচ্ছে। যেখানে আমদানি দায় পরিশোধে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা থাকছে। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, বৈদেশিক লেনদেনে কঠোর মনিটরিং ও ব্যাপকহারে কর আরোপ করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে অর্থ পাচার কমে আসবে। তবে এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।
বর্তমানে আমদানি-রপ্তানিসহ বৈদেশিক মুদ্রা সংক্রান্ত অন্যান্য লেনদেন বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭ অনুযায়ী হয়ে থাকে। সরকার পুরোনো এই আইনটিকে যুগোপযোগী করে ‘বৈদেশিক মুদ্রা ও বিনিময় ব্যবস্থাপনা আইন’ নামে নতুন আইন করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে আইনটির খসড়া চূড়ান্ত করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ওই চূড়ান্ত খসড়া তাদের ওয়েবসাইটে দিয়ে জন মতামত জানানোর অনুরোধ করেছে। খসড়ার ভূমিকায় বলা হয়েছে, দেশের বাইরে পরিশোধ, বৈদেশিক বিনিময় ও সিকিউরিটিজের লেনদেন, বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণ-রৌপ্যের আমদানি, রপ্তানি সংক্রান্ত কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের জন্য আইনটি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৪৭-এ আমদানি বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা রয়েছে। আবার বর্তমান আইনে মামলা করা বেশ জটিল প্রক্রিয়া। অন্যদিকে, বর্তমান আইনে কেউ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স নিয়ে একাধিক জায়গায় ব্যবসা করলে অথবা এক জায়গার নামে লাইসেন্স নিয়ে অন্য জায়গায় ব্যবসা করলে তাকে বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের আওতায় আনতে পারে না। প্রস্তাবিত আইনে এ ধরনের ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক যাতে ব্যবস্থা নিতে পারে সে ধরনের সুযোগ রাখা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, বিদেশের সঙ্গে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। দেশ থেকে বিদেশে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন অনেকে। আবার বিদেশ থেকে দেশে বিনিয়োগ আসছে। দেশে বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক লেনদেনে অনেক নতুন ধরনের পদ্ধতি, নিয়ম, ব্যবস্থা এসেছে, আগামীতে আরও আসবে। এসব বিবেচনায় আইনটি যুগোপযোগী করা দরকার। এ ছাড়া বাংলায় আইন করা সরকারের লক্ষ্য।
প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমদানি পণ্য দেশে আসতে হবে। নির্ধারিত পদ্ধতিতেই আসতে হবে। পণ্যের মান ও পরিমাণ ঠিক থাকতে হবে। এ সবের ব্যত্যয় হলে আমদানিকারকের পরবর্তী কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা আছে। কিন্তু আইনে নেই। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক নিষেধাজ্ঞা দিলেও আমদানিকারক আদালতে গিয়ে তা প্রত্যাহার বা স্থগিত করে আনেন। আইনে উল্লেখ না থাকায় আদালত সার্কুলারের আদেশ গুরুত্ব দেয় না। আমদানি মূল্য অনুযায়ী পণ্য বা সেবা দেশে না এলে আমদানিবাবদ পরিশোধ করা অতিরিক্ত অর্থ অথবা পুরো অর্থ ফেরত আনতে নির্দেশ দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইভাবে রপ্তানি দেশে আনার ক্ষেত্রে কম আনা হলে বা নির্ধারিত সময়ে আনা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানিকারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, আন্ডার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং ও ভুয়া বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের অর্থ পাচার ও কর ফাঁকির বিষয়ে সরকারের অবস্থান কঠোর। এ প্রবণতা রোধে আয়কর অধ্যাদেশে যেসব নিয়ম রয়েছে তার পাশাপাশি একটি নতুন ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করছি। প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী, যে পরিমাণ অর্থ আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং পাচার হয়েছে এবং যে পরিমাণ প্রদর্শিত বিনিয়োগ ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হবে, তার ওপর ৫০ শতাংশ হারে কর আরোপিত হবে। অর্থ পাচার ও কর ফাঁকি রোধে প্রস্তাবিত বিধান অত্যন্ত ফলপ্রসূ হবে।
বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচার নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স (জিএফআই)। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে তা উল্লেখ করা হয়। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে বৈশ্বিক বাণিজ্যের মাধ্যমে ২০১৫ সালে ৫৯০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। সংস্থাটি ১৪৮টি দেশের ওপর তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। জিএফআই বলছে, প্রধানত আমদানি-রপ্তানির সময় পণ্য ও সেবা মূল্য কম বা বেশি দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ নিয়ে যায়।