মোঃ আল আমিন প্রধান
আসছে ঈদুল ফিতর ! মূহুর্তে মূহুর্তে টিভি-রেডিওতে বেজে ওঠবে-
'ও মোন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।'
ঈদের আমেজ বয়ে বেড়াবে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের মাঝে যদিও এ বছরের করোনার মহামারিতে এ আনন্দে একটু ভাটা পড়বে তবে আমরা যে যেখানেই আছি সেখানে থেকেও আনন্দ উপভোগ করা যাবে। যেখানে মহামারী করোনার ভয়ঙ্কর থাবায় আমাদের স্বাভাবিক জীবন মৃত্যু যন্ত্রনায় গোংড়াচ্ছে সেখানে জীবন বাঁচানোটাই মূখ্য। ছোট বেলায় ঈদের আগমনের অপেক্ষায় অস্থির থাকতাম। শুধু ভাবতাম, আসছে সপ্তাহের পরের সপ্তায়, তার পর এই শুক্রবারের পরের শুক্রবার এভাবে ঈদের ঠিক আগের দিন হলেতো কোন কথাই নেই, রাতে ঘুমাতে পারতাম না ঠিকমতো শুধু গুনগুনিয় তাল মিলিয়ে গেয়ে যেতাম ‘ও মোন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ …….।’ এক অস্থিরতা বিরাজ করতো মনে। এপাস-ওপাস করেই রাতটা কোন মতে পার করতাম ।
প্রত্যেকটি দেশ বা জাতিকে টিকিয়ে রাখে তার ভাষা ও সংস্কৃতি। যখনি এসবের আকাল পড়বে বোঝতে হবে অন্য সংস্কৃতি নিজের সংস্কৃতিকে গ্রাস করতে বসেছে যার ফল হতে পারে মারাত্মক। বৃটিশরা একসময় পেশি আর বু্িদ্ধর বলে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশ সহ অনেক দেশ শাষণ-শোষণ করে গেছে কিন্তুু তারা চলে গেলেও সেসব দেশ গুলোতে তাদের সংস্কৃতির বীজ বপন করে গেছে যার ফলে তাদের রাজনীতি ও অর্থনীতির একটা বড় হাতিয়ার হয়ে দাড়িয়েছে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি যা কর্পোরেট অফিস সহ সকল সরকারী -বেসরকারী অফিস আদালতে অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাড়িয়েছে । এক কথায় একে কালচারাল পলিটিকস বলা যায়। জিও পলিটিকস এর চেয়ে এটা খুব কার্যকরী, একবার মানুষের মগজে ঢুকলেই হলো তা আর সহজে বের হয় না , অনেকটা এদেশে এক কালে আরব্য-রজনীর রূপকথার গল্প আর বর্তমানে আমাদের গ্রামীণ মায়েদের স্টার -জলসা আর জি-বাংলা দেখার মতো অবস্থা হয়ে যায়।
মূল কথায় আসি, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সর্বস্তরের লোকজন বয়সের ভেদাভেদ ভুলে টগবগিয়ে কণ্ঠ মিলিয়ে আনন্দের ফোয়ারা সৃষ্টিকারী ”ও মোন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ …….।” সঙ্গীতটি যখন গেয়ে ওঠে তখন ঈদের প্রকৃত আনন্দটাই মনে হয় খুঁজে পাওয়া যায় । কিন্তু ১৯৩১ সালে গানটি রচিত হওয়ার দু’মাস পর যখন তা প্রকাশ পায় তখনকার পরিবেশ কিন্তু ঠিক বাংলায় ইসলামী সঙ্গীতের অনুকূলে ছিলনা । শ্যামা সঙ্গীত আর কাওয়ালী গানের কদর তখন তুঙ্গে। “আব্বাসউদ্দীনের ‘দিনলিপি ও আমার শিল্পী জীবনের কথা” এবং যুগান্তরের -‘হামদ-নাতে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন নজরুল’ এবং অন্যান্য গবেষণা পত্রের আলোকে জানা যায় – প্রকৃত ইতিহাস।
আব্বাসউদ্দীন নজরুলকে সম্মান করেন, তাঁকে কাজীদা বলে ডাকেন, তিনি নজরুলকে ইসলামি গান লেখার জন্য অনুরোধ করেন। বাজারে তখন শ্যামা সঙ্গীতের রমরমা অবস্থা। নজরুল নিজেও শ্যামা সঙ্গীত লিখেন ও সুর দেন। গানের বাজারে যখন এই অবস্থা তখন আব্বাসউদ্দীনের এমন আবদারে নজরুল কী ভাবে নিবেন ! ছোট বেলায় মক্তবে পড়েছেন, কুর’আন শিখেছেন এমন কি তাঁর নিজের নামের সাথেও তো ‘ইসলাম’ আছে। তাই এ শব্দটার সাথে তাঁর কত আবেগ জড়িত।
আব্বাসউদ্দীনকে নজরুল খুব ভালোবাসেন, কিন্তু বাজারে যে অবস্থা, স্রোতের বিপরীতে সুর মিলানো চাট্টিখানি কথা না। তাই তিনি তাকে হ্যা সুচক কিছু বলতে পারেননি। সরঞ্জাম আলাদা, আর গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল-ইন-চার্জ হলেন ভগবতী বাবু। আব্বাসউদ্দীনকে বলেন, “আগে দেখ ভগবতী বাবুকে রাজী করাতে পারো কিনা।” কাজীদার কাছ থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে খুশি মনে ভগবতী বাবুর কাছে বল্লে তিনি কিছুতেই রাজী হচ্ছেন না। তিনি বলেন , ” মার্কেট ট্রেন্ডের বাইরে গিয়ে বিনিয়োগ করলে ব্যবসায় লালবাতী জ্বলতে পারে।” অনেক অনুরোধেও রাজী হননি বাবু। দীর্ঘ ছয়মাস অনুরোধে অনুরোধে অতিবাহিত হলো।
একদিন দেখলেন, ভগবতী বাবু খুব ফুরফুরে মেজাজে আশ্চর্যময়ীর সাথে খোশ গল্পে মত্ত আছেন, সুযোগ মতো আব্বাসউদ্দীন বল্লেন, “একবার এক্সপেরিমেন্ট করে দেখুন না, যদি বিক্রি না হয় তাহলে আর নেবেন না। ক্ষতি কী?” বাবু আর কত না বলবেন। এবার হেসে বল্লেন, “নেহাতই নাছোরবান্দা আপনি। আচ্ছা যান , করা যাবে। গান নিয়ে আসুন।” আব্বাসউদ্দীনের খুশিতে চোখে পানি আসার উপক্রম।
জানতে পারলেন পাশের ঘরেই কাজীদা আছেন, আর তিনি জানেন নজরুল চা আর পান খুব পছন্দ করেন, তাই এক ঠোঙ্গা পান আর চা আনতে দশরথকে পাঠিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকেই দেখেন কাজীদা ইন্দুবালাকে গান শিখাচ্ছেন, বুঝতে পারলেন খুব জরুরী কথা বলতে আব্বাস এসেছে। তিনি ইন্দুকে বলেন,” তুমি এখন বাড়ি যাও।” ভগবতী বাবুর রাজী হওয়ার কথা জানালেন। নজরুল বাইরে থাকতে বলেন কিছুক্ষণ, পান মুখে নিয়ে দরজা বন্ধ করে আধঘন্টার ভেতরেই লিখে ফেল্লেন, এদিকে বাইরে অপেক্ষারত আব্বাসউদ্দীনের আর ত্বর সইছে না। দরজা খুলেই পানের পিক বাইরে ফেলে তার হাতে কাগজ ধরিয়ে দেন।
আব্বাসউদ্দীন পড়তে পড়তে তার চোখ পানিতে ছলছল হয়ে উঠলো। এই সেই বিখ্যাত কালোজয়ী গান –
‘ও মোন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ,
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।’
নজরুল নিজেই এ গানের সুর তাকে শিখিয়ে দিলেন, এবং পরদিন আসতে বল্লেন। একটা গানের জন্য কত কাঠখোড় পোড়াতে হলো তার , এ যে একটা গান নয় , একটা সংস্কৃতির জীবন ফিরিয়ে দেওয়াই বলা চলে। এ গানের মধ্য দিয়েই তৎকালীন সময় ইসলামি সঙ্গীতের চাহিদা তৈরী হয়। আব্বাস উদ্দিনের এই কষ্ট বৃথা যায়নি , তার হাতের এ গানটিই যে বাংলার ইথারে ইথারে পৌছে যাবে। ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথে টিভি/রেডিওতে ভেজে উঠবে-”ও মোন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ …….।’
হয়তো এমনটা কখনো ভাবেননি।
তখনকার দিনে যন্ত্র ব্যবহার হতো শুধু হারমোনিয়াম আর তবলা। গানটা তখনো পুরোপুরি মুখস্ত হয়নি আব্বাসউদ্দীনের তার পরও মাইকের পাশ দিয়ে হারমোনিয়ামের ওপর ঠিক তার চোখ বরাবর হাত দিয়ে কাজীদা নিজেই সেই কাগজ খানা ধরলেন আর তিনি গেয়ে চল্লেন । দুই মাস পর ঈদুল ফিতরের সময় এ গানটির সাথে ‘ ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর,’ গানটিও বাজারে ছাড়া হবে। ঈদের বন্ধে বাড়ি গেলেন।
ছুটি কাটিয়ে যখন কলকাতায় ফিরে এসে ট্রামে চড়ে অফিসে যাচ্ছিলেন, বুকের ভেতর অনেক ধাপাধাপি করছিল কী জানি কী হল। তখন ট্রামে এক যুবক ওনার পাশেই গুন গুনিয়ে গাইছে-”ও মোন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ …….।’ প্রথমে নিজেন কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না পরে আবার যখন ভালো করে খেয়াল করলেন তখন বুঝলেন সত্যিইতো ছেলেটা তার গাওয়া গানটাই গাইছে। অফিসে ফিরে যখন গড়ের মাঠে গেলেন তখন আরেকটা দৃশ্য দেখে আরো অবাক হলেন, কয়েকটা ছেলে দলবেঁধে মাঠে বসে আছে আর তার মাঝ থেকে একটা ছেলে গেয়ে ওঠলো-‘ও মোন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ …….।’ আনন্দে তার সুখব্যথা হচ্ছে। এতো আনন্দ আর সইতে পারছেন না ।
তিনি দৌড়ে গেলেন তার কাজীদার কাছে। যেয়ে দেখেন তিনি দাবা খেলছেন , আব্বাসউদ্দীনের গলার আওয়াজ শুনেই খেলা থেকে লাফিয়ে ওঠে তাকে জড়িয়ে ধরে বল্লেন, ” আব্বাস, তোমার গান কী যে হিট হয়েছে।” ভগবতী বাবুও দারুন খুশি। এক সময় তিনি ভয়ে ছিলেন যে শ্যামা আর কাওয়ালী গানের মাঝে বাংলায় ইসলামি সঙ্গীত বাজার নষ্ট করবে আজ তিনিই নজরুল – আব্বাসকে বলছেন, ” এবার আরো কয়েকটি ইসলামি গান গাও না।” শুরু হলো নজরুল রচিত আর আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে ইসলামি গানের জাগরণ।
বাজারে এবার শুরু হলো ইসলামি সঙ্গীতের নতুন
ট্রেন্ড। এক সময় মুসলিম শিল্পীদের কয়েকজন শ্যামা সঙ্গীত গাইবার জন্য নাম
পরিবর্তন করে হিন্দু নাম রেখেছিলেন তাদের মধ্যে মুনশী মোহাম্মদ কাসেম
হয়েছিলেন ‘কে.মল্লিক, তালাত মাহমুদ হয়েছিলেন ‘তপন কুমার’। ঠিক তেমনি হিন্দু
শিল্পীদের ও কয়েকজন ইসলামি সঙ্গীত গাইবার জন্য মুসলিম নাম রাখা শুরু করেন।
তাদের মধ্যে ধীরেন দাস হয়ে যান ‘ গণি মিয়া’ , চিত্ত রায় হয়ে যান ‘দেলোয়ার
হোসেন’ গিরিস চক্রবর্তী হয়ে যান ‘ সোনা মিয়া’ হরিমতি হয়ে যান ‘সাকিনা
বেগম’ সীতা দেবী হয়ে যান ‘দুলি বিবি’ আর ঊষারাণী হয়ে যান ‘ রওশন আরা বেগম’।
তবে
বিখ্যাত অনেক হিন্দু শিল্পী স্ব-নামেও নজরুলের ইসলামি সঙ্গীত গেয়েছেন।
যেমন, অজয় রায়, ড. অনুপ ঘোষাল, আশা ভোঁসলে, মনোময় ভট্টাচার্য, রাঘব
চট্টোপাধ্যায়।
আব্বাসউদ্দীন আহমেদ তার দিনলিপিতে এ ব্যাপারে বলেন, ‘এই গান প্রকাশের মধ্য দিয়ে মুসলমানরা প্রথম জানতে পারল , তাদের সহিত্য সংস্কৃতি বলতে কিছু আছে। তারা ভাবল সাহিত্যে শত বছরের খরার পর এবার প্রকৃত কবির আবির্ভাব ঘটল।’ আর এ আত্মবিশ্বাসটি যে কবি জাগিয়ে দিতে পেরেছিলেন, তিনি নজরুল ছাড়া আর কেউ নয়।
কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামি গান লেখার সহজাত প্রতিভা ছিলো। তিনি অতি দ্রুত সময়ের মধ্যেই গান লিখতে পারতেন। একদিন আব্বাসউদ্দীন নজরুলের বাড়িতে গেলেন মূলত গজলের জন্য এবং তিনি তা কাজীদাকে বলেন, নজরুল তখন কী একটা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি তাকে হাতের ইশারায় বসতে বলে আবার লেখা শুরু করলেন । ইতোমধ্যে যুহরের আযান ভেসে আসলো। আব্বাসউদ্দীন বল্লেন,” আমি নামাজ পড়বো। কবি শিল্পীকে একটা পরিষ্কার জায়নামাজ দিয়ে বল্লেন, ” আগে নামাজটা পড়ে নিন।” নামাজ শেষ হয়েই দেখেন কাজীদা তার গজল লিখে ফেলছেন। তাও আবার তাার নামাজ পড়ার দৃশ্যপট নিয়ে?
“হে নামাজী ! আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ, দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ।”
বাংলায় নজরুলের দেখানো পথের পথিক হয়েছেন, জসীম উদ্দীন, ফররুখ আহমেদ, গোলাম মোস্তফা, হাল আমলের কবি মুহিব খান প্রমূখ। প্রতি বছর রমজানের ঈদ এলেই আমরা সবাই মনে মনে প্রচন্ড আবেগ তাড়িত হয়েই গেয়ে উঠি ”ও মোন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ …….।’ যা ঐ সময়ে ইসলামি সঙ্গীতের শতবছরের খড়া কাটিয়ে নবজাগরণের সূচনা করে দিয়ে গেলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিলো নাছেরবান্দা আমাদের প্রিয় লোকসঙ্গীত শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমেদের। আসছে ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে সশ্রদ্ধ চিত্তে সালাম নিবেদন করছি একই সাথে নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি রক্ষায় সবাই যেন সচেতন থাকি সে আশাও জাগীয়ে রাখছি।
লেখকঃ মোঃ আল আমিন প্রধান, শুল্ক কর্মকর্তা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।