দেশে বিদ্যুতের চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ক্ষমতা বেশি থাকলেও লোডশেডিং ও বিদ্যুৎ বিভ্রাট থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাগজপত্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকা এবং এর ফলে গ্রাহক ভোগান্তির ও ক্ষতির কোনো তথ্য নেই।
গ্রাহকের কাছে যা লোডশেডিং; বিতরণ সংস্থা-কোম্পানিগুলোর কাছে তা লোড ম্যানেজমেন্ট। গ্রাহক যাকে বলছেন বিদ্যুতের ‘আসা-যাওয়া’ তাকে এই সরকারি সংস্থাগুলো বলছে- কারিগরি ত্রুটি বা বিদ্যুৎ বিভ্রাট।
এমন প্রেক্ষাপটে শতভাগ বিদ্যুতায়নের দ্বারপ্রান্তে থাকা বাংলাদেশের মফস্বল-গ্রামের অনেক মানুষ বিদ্যুতের প্রকৃত উত্পাদন-বিতরণ ক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠছেন। গত এক যুগে দেশের-সরকারের অন্যতম বড় ও সেরা অর্জনের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন জনগণের একটি বড় অংশ। এমনকি স্থিতিশীল ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা না পেয়ে নিজস্ব ক্যাপটিভ বিদ্যুতের উপরই ভরসা রাখছেন শিল্পমালিক-উদ্যোক্তারা।
দেশে চালু থাকা ১৪১টি বিদ্যুেকন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২১ হাজার ৪৭৪ মেগাওয়াট। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুত্ যাচ্ছে দৈনিক গড়ে সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট। সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো বলছে, যতটুকু চাহিদা ততটুকুই বিদ্যুত্ বিতরণ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) দৈনিক উত্পাদন রিপোর্ট অনুযায়ী- গত সাড়ে ছয় মাসে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হয়েছে। কোনো লোডশেডিং হয়নি।
চলতি জুলাই মাসের ১ থেকে ১৫ তারিখে দেশের ছয়টি বিভাগে বিদ্যুতের দৈনিক চাহিদা বা সরবরাহ ছিল ৯ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট থেকে ১২ হাজার ৪৮৩ মেগাওয়াটের মধ্যে। উৎপাদন ক্ষমতা সরবরাহকৃত পরিমাণের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ থাকা সত্ত্বেও দেশের সবজেলার গ্রাহকদেরই অভিযোগ- এ সময়কালে এলাকাভেদে প্রায় প্রতিদিনই ১০ মিনিট থেকে ৫ ঘন্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ পাননি তাঁরা। বিদ্যুত্ বিভ্রাট নিত্যসঙ্গী তাদের। মুহূর্তের বা এক মিনিটের মধ্যে বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার কারণে ক্ষতি হচ্ছে অনেক ইলেক্ট্রিক, ইলেক্ট্রনিক এবং শিল্প যন্ত্রপাতির।
গত ১০ থেকে ১৫ জুলাই ২৩টি জেলায় ইত্তেফাকের প্রতিনিধিরা তাদের নিজ এলাকায় বিদ্যুত্ সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করেন। জেলাগুলো হলো- ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুর, খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, পঞ্চগড়, সিলেট এবং হবিগঞ্জ।
প্রতিনিধিরা জানান, এই ছয় দিনে তাঁদের এলাকায় দিনে এক থেকে পাঁচবার বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ ছিল। কিছু স্থানে বিদ্যুৎ না থাকার ব্যাপ্তি ছিল ১০ মিনিট। কয়েকটি এলাকায় তা চার ঘন্টা পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। তারা জানান, প্রতি বছর রমজান মাসে ইফতার, সেহরি, মাগরিব ও এশা নামাজের সময় প্রায় সময়ই বিদ্যুত্ চলে যায়। এ সময়ে বিদ্যুৎ না থাকার স্থায়িত্ব কম হলেও গ্রাহকরা বেশি বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হন।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন গত শুক্রবার বিদ্যুৎ সেবার অভিজ্ঞতা জানান কয়েকজন গ্রাহক। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) আওতাধীন এলাকায় বসবাসরত নাসিমা বেগম জানান, কয়েক দিন ধরে প্রতিদিন চার-পাঁচ বার করে তার এলাকায় বিদ্যুত্ থাকছে না। প্রতিবারে বিদ্যুত্হীন থাকার পরিমাণ প্রায় ১৫ মিনিট।
রামপুরার এক বাসিন্দা জানান, শুক্রবার রাত ১০টা ৫০ থেকে ১১টা ১০ পর্যন্ত তার এলাকায় বিদ্যুত্ ছিল না। ডেসকোর আওতাধীন মিরপুরের পীরেরবাগের বাসিন্দা রূপক ঘোষ জানান, প্রতিদিন অন্তত দুইবার করে লোডশেডিং হচ্ছে। শুক্রবার রাত ৮টায় এবং পৌনে ১১টায় তার এলাকায় বিদ্যুত্ ছিল না। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার রাহাত মাজহার জানান, শুক্রবার ৫ বার বিদ্যুত্ ছিল না তার বাড়িতে। প্রতিবার ৮-১০ মিনিট পর বিদ্যুত্ ফিরে আসে। নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার এস এম আলী আসগর জানান, ওই দিন চারবার তার এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না। প্রতিবারের লোডশেডিংয়ের পরিমাণ অন্তত ১ ঘন্টা।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ, পিডিবি বা আরইবি দেশে লোডশেডিংয়ের বিষয়টি অস্বীকার করলেও সম্প্রতি জ্তালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়। গত ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিত ওই সভার কার্যপত্রে তার উল্লেখ রয়েছে।
সভায় জ্তালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের আওতাধীন অনেকগুলো জায়গায় বর্তমানে ৩৩০ মেগাওয়াটের লোডশেডিং চলছে। এর কারণ জিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মাধ্যমে জানতে পারেন। তিনি জানান, সামিটের ভাসমান এলএনজি টার্মিনালটি (এফএসআরইউ) রক্ষনাবেক্ষণে থাকায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়টি আগে অবহিত না করায় তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
দেশের চার কোটি বিদ্যুত্ গ্রাহকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি)। সংস্থাটির ৮০টি সমিতির (পবিস) আওতায় তিন কোটি ১৩ লাখ গ্রাহক বিদ্যুত্ সেবা পাচ্ছেন। আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মঈন উদ্দিন বলেন, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে সমস্যা রয়েছে। বড় সমস্যা লো ভোল্টেজ। কক্সবাজারে রেললাইন উন্নয়ন-সম্প্রসারনের কাজের জন্য সেখানে দিনের কিছু সময় লোডশেড করা হয়।
খুলনা অঞ্চলে কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে সম্প্রতি বিদ্যুৎ সরবরাহে কিছু সমস্যা ছিল। বর্তমানে এ সমস্যা খুবই কম। বরিশাল ও নোয়াখালী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকতে পারে অল্প কিছু সময়ের জন্য, দীর্ঘ সময় নয়।
তিনি বলেন, সব জেলাতেই অনেক সময় সাবস্টেশন বা বিতরণ লাইনের শাটডাউন বা রক্ষনাবেক্ষন কাজের জন্যও কিছু সময় নির্দিষ্ট এলাকায় বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ থাকে। লো ভোল্টেজের কারণে কিংবা বিতরণ লাইনে গাছের ডাল-পাতা পড়ার কারণে হঠাতৎ করে বিদ্যুৎ চলে যেতে পারে। তবে এটি খুবই অল্প সময়ের জন্য।
একাধিক পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপকরা জানান, গ্রামীণ ও মফস্বল এলাকায় বিদ্যুত্ চলে গেলে অনেক সময় তথ্য পেতে দেরি হয়। আবার লোডশেডের বা কারিগরি ত্রুটির কারণ জানা গেলেও তা অনেক সময় দ্রুততার সঙ্গে মেরামত করা যায় না। সমিতিগুলোতে সেবা বাড়ানোর জন্য নিজস্ব যানবাহন এখন জরুরি।
দেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহূত হয় রাজধানী ঢাকায়। এখানকার দুইটি বিতরণ কোম্পানির একটি ঢাকা ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো)। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলী বলেন, ঢাকার বেশিরভাগ স্থানে বিদ্যুৎ লাইনের উচ্চতার চেয়ে আবাসিক বা বাণিজ্যিক ভবনের উচ্চতা বেশি। আমরা দেখেছি- ঢাকায় বারবার বা মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুৎ আসা যাওয়ার কারণ এ ভবন থেকে বিদ্যুৎ লাইনে ছুড়ে ফেলা বর্জ্য। এর কারণে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুত্ যায় ঢাকায়।
সরকারি ও বেসরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত এক যুগে বিদ্যুৎ খাতের সাফল্য দেশের অন্য অনেক খাতের চেয়ে বেশি। এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ কর্মকর্তাদের অনেকে চৌকষ কর্মী হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে ক্যাপটিভ এবং অবসরকৃত কেন্দ্রগুলোসহ সেই ক্ষমতা ২৫ হাজার ২২৭ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ গ্রাহকের সংখ্যা এক কোটি ৮০ লাখ থেকে চার কোটিতে উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু বিদ্যুৎ ব্যবহার (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্যসহ) বেড়েছে ২২০ কিলোওয়াট থেকে ৫১২ কিলোওয়াটে। চলতি বছরই দেশ শতভাগ বিদ্যুতায়িত হবে বলে আশাবাদী এ খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এমন অবস্থায় শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন নয়; নিরবিচ্ছিন্ন, স্থিতিশীল এবং মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা চান জনগণ।
সম্প্রতি একাধিক সভায়-আলোচনায় এ বিষয়ে আলোকপাত করেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে আমাদের কোনো সমস্য নেই। চ্যালেঞ্জ রয়েছে নিরবিচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে। সেজন্য অনেকগুলো পরিকল্পনা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। সেগুলো সম্পন্ন হলে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।
এদিকে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্তালানি উপদেষ্টা এবং তড়িত্ প্রকৌশলী অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুত্ও অনেক সময় উৎপাদন করা যাচ্ছে না। টাকা দিয়ে লো ভোল্টেজের মানহীন বিদ্যুৎ পাচ্ছে জনগণ। লোডশেডের বা বিদ্যুৎ বিভ্রাটের যে কারণ বলছে বিতরণ কোম্পানি-সংস্থাগুলো তা সহজেই নিরাময়যোগ্য। তাদের দেখানো কারণগুলোর অধিকাংশই গ্রহণযোগ্য নয়। দক্ষতা, আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে কাজ করলে নিরবিচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।