রাজধানীর ফুসফুস খ্যাত ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কেটে চলছে উন্নয়নকাজ। উদ্যানে ওয়াকওয়ে ও সাতটি ফুড কর্নার বানানোর জন্য ইতিমধ্যে কাটা হয়েছে ৪০-৫০টি গাছ। আরো প্রায় অর্ধশত গাছ পর্যায়ক্রমে কাটা হবে বলে জানা গেছে। স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ের কাজের অংশ হিসেবে এই উন্নয়নকাজ চলছে। প্রায় অর্ধশত বছরের পুরোনো এই গাছ কাটা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিতর্ক, চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
উদ্যানের গাছ কাটা বন্ধে সরকারকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রেস্টুরেন্ট বা দোকান নির্মাণের নামে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী এই উদ্যানের গাছ কাটার কোনো সুযোগ নেই। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এ কার্যক্রম বন্ধ করা না হলে হাইকোর্টে আদালত অবমাননার মামলা করা হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী ও প্রধান স্থাপত্যবিদ বরাবর ই-মেইলযোগে এ নোটিশ দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংরক্ষণ নিয়ে হাইকোর্টের রায় তুলে ধরে নোটিশে বলা হয়েছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকা নিছক কোনো এলাকা নয়, এই এলাকা ঢাকা শহর পত্তনের সময় থেকে একটি বিশেষ এলাকা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে এবং এর একটি ঐতিহাসিক ও পরিবেশগত মূল্য রয়েছে। শুধু তাই নয়, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু এই এলাকা। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ এলাকাটি একটি বিশেষ এলাকা হিসেবে সংরক্ষণের দাবি রাখে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেছে স্থাপত্য অধিদপ্তর। স্থাপত্য অধিদপ্তরের নকশা অনুসারে এই নির্মাণকাজ চালাচ্ছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। উদ্যানের দায়িত্বে থাকা কার্পেন্টার নজরুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘আমরা জানি না এখানে কী গাছ কাটা হচ্ছে। এটা অফিসাররা ভালো বলতে পারবেন।’ অন্যদিকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী শামিম আখতার জানান, নিয়ম মেনেই গাছ কাটছেন তারা।
কয়েক জন নির্মাণশ্রমিক জানান, বসেরা তাদের কয়েকটি এলাকা দেখিয়ে দিয়েছেন। দেখানো জায়গায় যত গাছ আছে সেগুলো কাটতে হচ্ছে তাদের। গাছ কাটার সময় কয়েক জন এসে বাধা দিয়েছিল। কিন্তু বসেরা কাজ চালিয়ে যেতে বলেছেন। আমরা চুক্তিতে কাজ করছি। এর বেশি কিছু জানি না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সব প্রবেশপথসহ বিভিন্ন স্থানে অন্তত সাতটি ফুডকর্নার স্থাপন করার কাজ শুরু করেছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। তাদের দাবি, এ জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদনও রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে রাতের আঁধারে গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে। উদ্যান এলাকায় রেস্তোরাঁ তৈরি করতে বড় আকারের সাতটি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি রেস্তোরাঁর নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো দাবি করছে, শিমুল, জারুল, গগনশিরিষ, রয়্যাল পামসহ অন্তত ১০০ গাছ কাটা হয়েছে। কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবারি কালচার সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক মিহির লাল সাহা বলেন, ‘কোনো ধরনের যুক্তি ছাড়া উন্নয়নের নামে গাছ কেটে ফেলা যৌক্তিক নয়। একটি গাছ এত বড় হয়েছে, আমাদের পরিবেশকে পরিষ্কার করে দেয়, কার্বন-ডাইঅক্সাইড শোষণ করে নিয়ে আমাদের অক্সিজেন সরবরাহ করে, এরকম একটি গাছ তো দু-একদিনে বড় হয় না। এগুলোকে রক্ষা করেই যে কোনো পরিকল্পনা নেওয়া উচিত।’
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যায় বলেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণ, আধুনিক নগর উপযোগী সবুজের আবহে আন্তর্জাতিক মানের গড়ে তোলা ও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে ‘ঢাকাস্থ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে বর্তমানে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণকাজ যেমন, পাকিস্তানি শাসনবিরোধী ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রাম ও ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-সংবলিত ভাস্কর্য স্থাপন, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের স্থানে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্থানে ভাস্কর্য স্থাপন, ইন্দিরা মঞ্চ নির্মাণ, ওয়াটার বডি ও ফাউন্টেইন নির্মাণ, ভূগর্ভস্থ ৫০০ গাড়ির ধারণ ক্ষমতার কার পার্কিং এবং শিশুপার্কসহ বিভিন্ন নির্মাণকাজ চলছে। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কিছু গাছ কাটা হলেও প্রায় ১ হাজার গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রতিবাদ
গাছ কাটায় বেশ কয়েক দিন যাবত্ প্রতিবাদ করে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তারা উদ্যান এলাকায় প্রতিবাদী ব্যানার, মানববন্ধন ও বিভিন্ন শিল্পকর্মের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। ষোল আনা বাঙালি নামে সংগঠনের পক্ষে লাগানো ব্যানারে লেখা হয়েছে, ‘পরিবেশ প্রকৃতির অলংকার, বাংলাদেশ আমার অহংকার; গাছ কাটা বন্ধ করো। ’
উদ্যানের পরিবেশ নষ্ট করে এ রকম রেস্টুরেন্ট তৈরি করা নিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষার্থী ওম প্রকাশ বলেন, ‘সৌন্দর্য বর্ধন করতে চাইলে গাছ না কেটেও সৌন্দর্য বর্ধন করা যায়। গাছ কাটার মাধ্যমে প্রকৃতিকে বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে। এখানে অসংখ্য প্রাণী বসবাস করে। গাছ কাটলে এসব প্রাণী কোথায় যাবে? প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে এসব রেস্টুরেন্ট নির্মাণ বন্ধ করা উচিত। করলেও সেটা পরিবেশ প্রকৃতি নষ্ট না করে পরিকল্পিতভাবে করতে হবে।’
নোঙর বাংলাদেশ, স্বাধীনতা উদ্যান সাংস্কৃতিক জোট, গ্রিন প্লানেট নামে তিনটি সংগঠন গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে। গত বুধবার উদ্যান গেটে একটি মানববন্ধনের আয়োজন করেন তারা। বৃহস্পতিবার উদ্যান এলাকায় শিক্ষার্থীরা আরেকটি মানববন্ধন করেন। মানববন্ধন থেকে তরুণ নাট্য নির্মাতা সুদীপ সজীব বলেন, সৌন্দর্যবর্ধনের নামে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। যেখানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে প্রকৃতি বাঁচিয়ে রেখে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়, সেখানে আমাদের দেশে গাছ কেটে হাঁটার পথ, খাবারের দোকান বানানো হচ্ছে। একটু চেষ্টা করলেই গাছগুলো বাঁচানো যেত। উদ্যানের এ গাছ হত্যার মাধ্যমে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।