দেশে চিকিৎসাধীন করোনা রোগীর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগীর মধ্যে সুস্থ হওয়া ও মারা যাওয়া ব্যক্তিদের বাদ দিলে দেশে গতকাল মঙ্গলবার চিকিৎসাধীন রোগী ছিলেন ১ লাখ ২ হাজার ১২৮ জন। দেড় মাস আগেও দেশে চিকিৎসাধীন রোগী ছিলেন ৪০ হাজার।
এদিকে করোনায় দেশে মৃত্যু কমছেই না। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত আরও ৬৯ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে। গত মার্চ মাসে মোট ৬৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আর চলতি এপ্রিলের প্রথম ১৩ দিনে মারা গেছে ৮৪৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৬ হাজার ২৮ জন।
দেশে গত মার্চ থেকে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হচ্ছে। দৈনিক শনাক্ত ও মৃত্যুতে নিয়মিত রেকর্ড হচ্ছে। পরিস্থিতি সামলাতে আজ বুধবার থেকে সারা দেশে আট দিনের ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ দিয়েছে সরকার। এর আগে গত এক সপ্তাহ ধরে ঢিলেঢালা লকডাউন চলেছে। এই লকডাউনের ফল এখনো দেখা যায়নি।
চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করায় করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালেও চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) সংকট দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রাজধানীর ২৭টি হাসপাতালে মাত্র ৮টি আইসিইউ শয্যা ফাঁকা ছিল। আর ৪ হাজার ১৭৬টি সাধারণ শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি ছিল ৩ হাজার ৫৪৯টি শয্যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাজধানীর মাত্র ১৭টি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগীর তথ্য দিচ্ছে। এই তালিকার বাইরেও বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে এখন অনেক করোনা রোগী চিকিৎসাধীন। তাদের হিসাব দিচ্ছে না অধিদপ্তর। এসব তথ্য যুক্ত করলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা অনেক বাড়বে। অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে চিকিৎসাধীন রোগীর মধ্যে ৬ হাজার ১৪২ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাকি ৯৫ হাজার ৯৮৬ জন বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।
জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ বাড়িতে থাকা বিপুলসংখ্যক রোগীর নিয়মিত ফলোআপ করছে না। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি রোগী, তাঁদেরও ঠিকমতো ফলোআপ হচ্ছে না। বাড়িতে থাকা রোগীরা কেমন আছেন, কী ওষুধ খাচ্ছেন এগুলো জানতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে নির্দেশ দিতে হবে স্থানীয়ভাবে যেন পরিকল্পনা করে রোগীদের ফলোআপ করা হয় এবং সেই তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেড় মাসের ব্যবধানে দেশে চিকিৎসাধীন করোনা রোগী বেড়েছে ৬১ হাজার ৫৪০ জন। চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম ১৩ দিনে দেশে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৮৬ হাজার ৬৯০ জনের। বিপরীতে এই সময়ে সুস্থ হয়েছেন ৪১ হাজার ২৮ জন।
গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা তিন মাস শনাক্তের চেয়ে সুস্থ বেশি হওয়ায় দেশে চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা কমে এসেছিল। কিন্তু গত মার্চ থেকে দেশে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে শুরু করার পর পরিস্থিতি বদলে গেছে।
পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারস শুরু থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনাবিষয়ক হালনাগাদ তথ্য দিয়ে আসছে। গতকাল সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ওয়ার্ল্ডোমিটারসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সংক্রমণ শনাক্তের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৩তম। তবে চিকিৎসাধীন রোগীর দিক থেকে বাংলাদেশ ২৩তম স্থানে।
১৪ দিন ধরে দেশে দৈনিক ৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে ৬ এপ্রিল থেকে দৈনিক ৬০-এর ওপরে মৃত্যু হচ্ছে। গত সোমবার তা ৮০ ছাড়িয়েছিল। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, তীব্র উপসর্গ থাকা ব্যক্তির মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। তবে গত বছরের চেয়ে এবার তীব্র উপসর্গ নিয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেশি। এবার কম সময়ে ফুসফুস আক্রান্ত হচ্ছে বলে তাঁরা ধারণা করছেন।
কোনো দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঠিক করা কিছু নির্দেশক থেকে বোঝা যায়। তার একটি হলো রোগী শনাক্তের হার। টানা দুই সপ্তাহের বেশি রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে রোগী শনাক্তের হার ৩ শতাংশের নিচে ছিল। দুই মাসের বেশি সময় পরে গত ১৮ মার্চ শনাক্তের হার ১০ শতাংশ ছাড়ায়। চলতি মাসের অধিকাংশ দিনই শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ঘরে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৩২ হাজার ৯৫৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। গতকাল পর্যন্ত মোট ৬ লাখ ৯৭ হাজার ৯৮৫ জনের দেহে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৯ হাজার ৮৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৯৬৬ জন।