টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক নাঈমা সিফাতের প্রথম করোনা শনাক্ত হয় গত বছরের ২৪ এপ্রিল। ওই সময় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছিল। পরীক্ষায় একজন চিকিৎসক ছাড়া অন্য কারও করোনা শনাক্ত হয়নি।
নাঈমা সিফাত বলেন, ‘করোনা শনাক্ত হওয়ার পর প্রথমে বাড়িতে আইসোলেশনে ছিলাম। পরে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছিলাম।’ সুস্থ হয়ে তিনি কাজেও যোগ দেন।
জুনের শুরুতে এই চিকিৎসক আবার করোনায় আক্রান্ত হন। দেশে করোনায় দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার এটি প্রথম বা একমাত্র ঘটনা নয়। গত বছর এ ধরনের ঘটনা আরও শোনা গিয়েছিল। অতি সম্প্রতি সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনায় দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। তৃতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। তবে কতজন দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছে, তার হিসাব কোনো দপ্তরে নেই।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার সংক্রমিত হওয়ার সঠিক পরিসংখ্যান দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে আমরাও পুনঃ সংক্রমণের (রিইনফেকশনের) নমুনা পাচ্ছি।’
দ্বিতীয়বার সংক্রমণ নিয়ে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন আছে। করোনার প্রথমবার সংক্রমণের কত দিন পর দ্বিতীয়বার সংক্রমণ হতে পারে? কত মানুষের দ্বিতীয়বার সংক্রমণ হচ্ছে? দ্বিতীয়বার সংক্রমণে রোগের তীব্রতা কি প্রথমবারের চেয়ে বেশি দেখা দেয়? প্রথম ও দ্বিতীয়বার সংক্রমণ কি করোনাভাইরাসের একই ভেরিয়েন্টের (রূপান্তরিত ধরন) মাধ্যমে ঘটে? দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে টিকা দিয়ে কি কোনো লাভ আছে?
এসব প্রশ্নের সহজ কোনো উত্তর নেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন টিকা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সকলের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে না। তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকছে। একইভাবে ভাইরাসে সংক্রমিত হলেও সকলের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না। যাদের হয় না, তাদের দ্বিতীয়বার সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। তবে এ নিয়ে গবেষণা হওয়া দরবার।’
সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে নোবেল করোনাভাইরাস বহুবার রূপান্তরিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধরন বা ভেরিয়েন্টের বিস্তার আছে। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশে ইউকে ভেরিয়েন্ট ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভেরিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে এবং তাদের বিস্তারও হচ্ছে। গত বছর মার্চে বাংলাদেশে মূলত ইতালি থেকে আসা ভেরিয়েন্টের বিস্তার ঘটেছিল।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রুবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে দ্বিতীয়বার সংক্রমণের ঘটনা বেশি দেখা গেছে।’ তিনি বলেন, বর্তমানে ওই হাসপাতালের দুজন চিকিৎসক দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে একজনের পরিস্থিতি কিছুটা জটিল।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক টিটো মিয়া বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয়বার সংক্রমণের যে ঘটনা পাওয়া যাচ্ছে, তা–ও মূলত স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে।
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক নিহার রঞ্জন দাস গত বছর সাত মাসের মধ্যে তিনবার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বার আমার জটিলতা বেশি ছিল এবং দ্বিতীয়বারের চেয়ে তৃতীয়বার জটিলতা বেশি ছিল।’
পুনঃসংক্রমণ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা দপ্তর থেকে সর্বসাধারণের উদ্দেশে বক্তব্য বা বার্তা দেওয়া দরকার বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘পুনঃসংক্রমণের ঝুঁকির বিষয়ে মানুষকে সাবধান করতে হবে। সংক্রমণের পর সুস্থ হয়ে মানুষ যেন বেপরোয়া চলাফেরা না করে, সে ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। পাশাপাশি কী হারে মানুষ পুনঃসংক্রমিত হচ্ছে, তা জানার ব্যবস্থা করতে হবে।’