করোনা মহামারী শুরুর পরপর সাধারণ ছুটির মধ্যে লোকজনের হাতে বেশি করে টাকা জমিয়ে রাখার প্রবণতা বাড়তে দেখা যায়। এর প্রমাণ মেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেও।
মুদ্রা ও বিনিময় হার নিয়ে করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের জনগণের হাতে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা ছিল। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে জনগণের হাতে থাকা মুদ্রার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে লোকজনের হাতে টাকা বেড়েছে ৩০ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। খরচের জন্য হাতে টাকা রাখার হার বেড়েছে ১৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জনগণের হাতে টাকা রাখার হার বেড়েছিল ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ বা ১১ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের লোকজনের হাতে ছিল ১ লাখ ৪৪ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা।
দৈনন্দিন জীবনের ব্যয় নির্বাহ বা পণ্য ও সেবা নেওয়ার জন্য প্রতিদিনই কিছু না কিছু টাকা খরচ করতে হয়। এর বাইরে বাড়তি টাকা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা থাকে। দেশের মোট প্রচলনে থাকা মুদ্রা থেকে ব্যাংকে জমানো টাকা বাদ দিয়ে লোকজনের হাতে কত টাকা আছে সেই তথ্য বের করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যাংকে আমানত রেখে এখন খুব বেশি সুদ পাওয়া যায় না। বরং জমানো টাকার ওপর ভ্যাট ও আবগারি শুল্ক পরিশোধের পর যে পরিমাণ মুনাফা হয়, মূল্যস্ফীতি তার থেকে বেশি। ফলে আমানতের প্রকৃত মুনাফা কমে যাচ্ছে। এছাড়া নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য পুঁজিবাজারকে আস্থায় নিতে পারছেন না ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। এ কারণে টাকা না জমিয়ে ভোগে ব্যয় করছেন তারা।
জানা গেছে, বর্তমানে ব্যাংকে আমানত রেখে ৪ থেকে ৬ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। মুনাফার ওপর ভ্যাট আছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। বছরের যেকোনো সময় আমানত ১ লাখ টাকা ছাড়ালে ২০০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হয়। আমানত যত বেশি হবে আবগারি শুল্ক তত বেশি।
অন্যদিকে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হঠাৎ হঠাৎ বাড়ছে। বর্তমানে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে রয়েছেন ক্রেতারা। প্রতি লিটার তেলে দাম বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা। গত জানুয়ারিতে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।
অর্থাৎ এক বছর আগে যে খাদ্যপণ্যের পেছনে ব্যয় হতো ১০০ টাকা এখন সেখানে ব্যয় করতে হচ্ছে ১০৫ টাকা ২৯ পয়সা। এ ক্ষেত্রে এক বছর ব্যাংকে টাকা রেখেও মানুষ এখন ১০০ টাকায় সর্বোচ্চ ৬ টাকা মুনাফা পাচ্ছেন। এর মধ্যে আবার ভ্যাট ও আবগারি কর কাটলে এই মুনাফা আরও কমে যায়। অর্থাৎ ব্যাংকে টাকা রাখা বা না রাখা একই কথা।
লোকজন এভাবে আমানতবিমুখ হতে থাকলে দেশের সঞ্চয়প্রবণতা কমে যাবে বলে মনে করছেন পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যাংকের বাইরে (কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক) টাকা বেশি থাকা ভালো লক্ষণ নয়। এর অর্থ হচ্ছে মানুষ ব্যাংকে বেশি আগ্রহ পাচ্ছে না। তারা হয়তো আগে চলতি হিসাবে বা স্বল্পমেয়াদে রাখত। এখন সেখানে তেমন কোনো মুনাফা নেই বললেই চলে। সে কারণেই হয়তো মানুষ টাকা হাতে বা ঘরে রেখে দিচ্ছে।
এছাড়া দেশে কালো টাকা যত বাড়বে ততই ব্যাংকের বাইরে টাকা বেশি চলে যায়। এক্ষেত্রে কালো টাকার মালিক যাতে হতে না পারে সেজন্য ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম বন্ধেও নজর দিতে হবে। কেবল কালো টাকা সাদা করার সুযোগই যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে দেশের মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের গচ্ছিত আমানতের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ৯০ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে মেয়াদি আমানত ছিল ১১ লাখ ৪২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। তলবি বা চলতি আমানত ছিল ১ লাখ ৪৮ হাজার ১৭২ কোটি টাকা।