মো: শামসুদ্দোহা
ত্রাণ আত্মসাৎ কারীরা হল তেলাপোকার মত আগেও ছিল,এখন আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এখন ভাবতে পারেন এরা যে ভবিষ্যতেও থাকবে তা আপনি বুঝলেন কিভাবে? উত্তর খুবই সোজা আগে যেভাবে এই তেলাপোকার দল টিকে ছিল, ঠিক এখনও সেইভাবেই তাদের টিকে থাকতে দেয়া হচ্ছে। ধরুন, ভোলার বোরহানূদ্দিন উপজেলায় ত্রাণের চাল আত্মসাৎ ও কালোবাজারে বিক্রির উদ্দেশ্য মজুদের ঘটনায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে আসামিকে মাত্র ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করে মুক্তি দেয়া হল। এইযে, গুরু পাপে লঘু দন্ড দেয়া হল এতে তো চোর চুরি করার জন্য উৎসাহ পাবে। পাচ্ছে ও তাই। দলীয় লোক হলে কম সাজায় পার পেয়ে যাচ্ছে কিনা এটাও দেখতে হবে। যে দলেরই হোক কেউ জানি অপরাধ করে পার না পায় সে বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কড়া হুশিয়ারি রয়েছে তা সকলেরই জানা।
মোবাইল কোর্ট নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়, সকলে একমত হবেন যে জাতির সব থেকে মেধাবী সন্তানদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে কারণ তারা সবাই বিসিএস কর্মকর্তা। তাদের মেধা ও যোগ্যতা নিয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই । কিন্তু তার আগে একটু বলুনতো জীববিজ্ঞান,ম্যাথ বা হিসাব বিজ্ঞান বা অন্য যে কোন বিভাগের শিক্ষকদের দিয়ে যদি আইনের ছাত্রদের ক্লাস নেয়া হয়, তবে অই ছাত্রদের কি অবস্থা হবে? যদিও তা আমার বোধগম্য নয়। কেননা এই রকম নজীর এখন গড়ে উঠতে পারে নাই। তবে অন্য অন্য বিভাগের ছাত্রদের দিয়ে যদি আইনের প্রয়োগ হতে পারে তবে অন্য বিভাগের শিক্ষক দিয়ে আইন পড়ান যেতে পারে। মাঝে মাঝে খবর শোনা যায়, এক হাত ভেঙ্গে গেছে অন্যহাত অপারেশন করা হচ্ছে। এদের দিয়ে আইন প্রয়োগে, সমাজের অন্য হাতের অপারেশন হচ্ছে বারে বার। মোবাইল কোর্ট নিয়ে অনেক কথা বলা যায় ।
উল্লেখ্য যে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ন্যাচারাল জাস্টিস নামে একটি গুরুত্ব পূর্ণ একটি মতবাদ। যে মতবাদটি শুধু আইন প্রয়োগই নয় বরং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই ন্যাচারাল জাস্টিস কনসেপ্ট আবার দুটি তত্ত্বের মাধ্যমে গঠিত।
প্রথম তত্ত্বটি হল “কেউ নিজের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে নিজে বিচারক হতে পারবে না” এই ধারণাটা কেন আসল? এটা এসেছে বিচারকের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য, কারণ নিরপেক্ষ বিচারক ছাড়া ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আর মোবাইল কোর্টের ক্ষেত্রে কি হয়? যে অভিযোগ আনয়ন করে,সেই সাক্ষী আবার সেই বিচারক। কি একটা অভিনয়!বিচারক একা তিনটি চরিত্রে অভিনয় করে কখন সে ফরিয়াদি আবার একটু পরে সে চাক্ষুষ সাক্ষী এর কিছুক্ষণ পর আবার সে বিচারক। এই বিচার যে করবে সে তো কখন নিরপেক্ষ হতে পারে না।
দ্বিতীয় তত্ত্বটি হল “ কাউকে অত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়ে বিচার করা যাবে না” এখন আত্মপক্ষ সমর্থন কার সামনে হতে হবে? অবশ্যই একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির সামনে হতে হবে, আর যাই হোক যে ব্যক্তি অভিযোগ আনয়ন করে তার সামনেই অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থন মূল্যহীন। অনেকেই আবার তর্কের খাতিরে বলেন যারা মোবাইল কোর্টের বিচারক হন ,তারা যে আইনগুলোর মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে সে আইনগুলো তাদের ভাল জানা থাকে। তাদেরকে বলব আইন আসলে কোন বিচ্ছিন্ন ব্যবস্থা না, যে পর্যন্ত একটা অপরাধের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত আইন ও সম্পর্কিত সমস্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিতে পারবেন সে পর্যন্ত সমাজের উপর একটা অপরাধের প্রভাব নির্ণয় করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আর তখনি ত্রাণ আত্মসাৎ, কালোবাজারি আর মজুদের মত গুরুতর অপরাধগুলো শুধুমাত্র জরিমানা করে প্রাণ হারায়।
এবার দেখাব ত্রাণ আত্মসাৎ কারীর অপরাধের ধরণগুলো: প্রথমত এরা সংবিধানের আওতায় অপরাধ করছে। কেননা এরা সংবিধানের ১৫ নং অনুচ্ছেদ এবং সংবিধানের ৩২ নং অনুচ্ছেদের আওতায় জনসাধারণের দুটি সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে। অনুচ্ছেদ ১৫ তে মৌলিক প্রয়োজনের কথা বলা হয়েছে যার মধ্য খাদ্য প্রথম এবং অন্যতম প্রধান মৌলিক প্রয়োজন। আর অনুচ্ছেদ ৩২ জীবন রক্ষার অধিকারের কথা বলা হয়েছে । আর খাদ্য নিশ্চিত করা ছাড়া এই মহামারীতে জীবন রক্ষা অসম্ভব।
ধরুন ত্রাণ কেউ ত্রাণ আত্মসাৎ করল, আর তার আওতাধীন এলাকায় খাদ্য অভাবে কেউ মারা গেল, আপনি কি মনে করেন এই ক্ষেত্রে তাকে চুরি বা আত্মসাৎ বা প্রতারণার শাস্তি দিলে ন্যায়বিচার হবে? কখনই না, কারণ অই চোরের অপরাধ অনিচ্ছাকৃত হত্যার শামিল। কেননা একজন সাধারণ সুস্থ মানুষের এইটুকু জ্ঞান আছে যে, মহামারীর মুহূর্তে ত্রাণ না পেলে যে কেউ মারা যেতে পারে । এই অপরাধের জন্য পেনাল কোডের ৩০৪ ধারা অনুযায়ী ১০ বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে।
আসলে বর্তমানে ত্রাণ নিয়ে যে অপরাধ গুলো সে গুলো আমার মতে কোন ভাবে চুরি নয়, কেননা দণ্ডবিধিতে চুরির যে সংজ্ঞা প্রধান করা হয়েছে তার মধ্য এই অপরাধ পরে না। দন্ডবিধির ৩৭৮ ধারা অনুযায়ী চুরি হল “কার দখল থেকে অসাধুভাবে গ্রহণ করার ইচ্ছা নিয়ে কোন অস্থাবর সম্পদের স্থানান্তর” কিন্তু এই ক্ষেত্রে কি হচ্ছে সরকার কিছু ব্যক্তিবর্গকে বিশ্বাস করে ত্রাণের সম্পদ জনগণের মাঝে বিতরণের জন্য দিচ্ছে কিন্তু এটা তারা অবৈধভাবে মজুদ করছে তাদের ব্যবহারের জন্য অথবা বিক্রির জন্য। বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ ধারা এই অবৈধভাবে মজুদের অপরাধকে মজুদদারি এবং এই পণ্য বেচাকেনাকে কালোবাজারি বলে এর শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন বা ১৪ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা।
এই অপরাধ গুলোকে আরেকটা নামে অভিহিত করা যায়, আর সেটা হল এটাকে অপরাধ মূলক বিশ্বাসভঙ্গ বলা যেতে পারে। কেননা দণ্ডবিধির ৪০৫ ধারা অনুযায়ী “কোন সম্পত্তির উপর অধিপত্যের ভারপ্রাপ্ত হয়ে তা আত্মসাৎ বা নিজের ব্যবহারে পরিণত করাকে” অপরাধ মূলক বিশ্বাসভঙ্গ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সাধারণ ক্ষেত্রে এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে ৩ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে । কিন্তু যারা এই ত্রাণ আত্মসাৎ করতেছে তারা তো সাধারণ মানুষ না। তারা এই ক্ষেত্রে সরকারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। কেননা সরকার তাদের দায়িত্ব দিয়েছেন জনগণের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেবার। আবার তারা কিন্তু জনগণের ও এজেন্ট এই জন্য তদের আমরা জনপ্রতিনিধি বলে থাকি।
এখন এই অপরাধ মূলক বিশ্বাসভঙ্গ কোন এজেন্ট এর মাধ্যমে হয় তার শাস্তি হল দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং জরিমানা। এই তো গেল ত্রাণ আত্মসাৎ করণে যারা সরাসরি যুক্ত এবার আসুন যারা আত্মসাৎ করতে সাহায্য করেছে যেমন ধরুন যারা যানবাহন দিয়ে অথবা কায়িক শ্রম দিয়ে সাহায্য করছে তাদের শাস্তি দিবেন না ? তারা এই আত্মসাতের সহায়তাকারী হিসেবে শাস্তি পাবে। এবার আসি ত্রাণ আত্মসাৎ করার পরের ঘটনায়, যারা এই ত্রাণ আত্মসাৎকৃত মাল গোপন করছে, তাদের শাস্তি দিবেন না? তাদের সাঁজা দণ্ডবিধির ৪১৪ ধারা অনুযায়ী ৩ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। এবার আসি যারা এই মালামাল ক্রয় করে, তাদের শাস্তি দিবেন না? তাকে অবশ্যই কালোবাজারি করণে সহায়তাকারী হিসেবে শাস্তি দিতে হবে।
উপরোক্ত শাস্তি ছাড়াও এই ত্রাণ আত্মসাতের ঘটনা যদি কোন জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে ঘটে, তবে আইন করে তদের পদ শূন্য করা উচিৎ, তারা যেন আর কখন জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন না করতে পারে তার ব্যবস্থা করা উচিৎ, এবং সে যেন কোন দলের রাজনীতিতে যুক্ত নয়া হতে পারে এই মর্মে নিষেধাজ্ঞা দেয়া উচিৎ। তাহলে আর কেউ অন্তত জনপ্রতিনিধি হয়ে ত্রাণ আত্মসাৎ করার আগে দুইবার ভাববে।
এত এত আইনের বিধান থাকা সত্ত্বেও ২০১৮ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন নামে একটি আইন করে ত্রাণ আত্মসাৎ কারীদের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে মাত্র ১ বছরের জেল অথবা ১ লক্ষ টাকা জরিমানা অথবা উভয়দন্ড। এখন বিষয় হল এই আত্মসাৎ কারীদের বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় বিচার করবেন নাকি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের আওতায় বা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এই ত্রাণ আত্মসাৎ কারীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবেন, সিদ্ধান্তটা নেয়ার সময় এখনই।
পরিশেষে বলব, একটা অপরাধের ধরণ এবং সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব অথবা সম্ভাব্য ক্ষতি কি হতে পারে? তা নির্ণয় না করতে পারলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। আর ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে সামাজিক নিরাপত্তা, সামাজিক সাম্যতা, সামাজিক কল্যাণ, সামাজিক স্বচ্ছতা কথাগুলো কিছু বিলাসী শব্দ ছাড়া কিছুই রইবে না। ত্রাণ চোরেরা অধরা থাকলে হেরে যাবে বাংলাদেশ আর করোনা জিতে যাবে।
লেখকঃ মো: শামসুদ্দোহা, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ, Email: mdshamsuddoha.law@gmail.com