ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধে আইনটি পর্যালোচনার কথা ভাবছে সরকার। আইন সংশোধন না করে বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে অপপ্রয়োগ ও হয়রানি বন্ধে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কাজ শুরু করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ ওঠার পর পুলিশের তদন্তের আগে গ্রেপ্তার না করার বিধান আসতে পারে।
আইন মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গতকাল মঙ্গলবার বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক থাকা অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর অপপ্রয়োগ বন্ধে আবারও বিভিন্ন মহল থেকে আইনটি সংশোধনের দাবি উঠেছে। মূলত আইনটির অজামিনযোগ্য ধারা এবং অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশের তদন্ত ছাড়াই গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে। দেশে গত শনিবার থেকে আইনটি বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিবৃতিকে আমলে নিয়ে সরকার চিন্তা করছে আইনটির সঠিক প্রয়োগের বাধা দূর করে বিধি প্রণয়নের।
এদিকে সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা বলছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সময়োপযোগী এবং এ আইনের প্রয়োজনও অনেক বেশি। তবে অপপ্রয়োগ ও হয়রানি বন্ধে এখন আইনটি পর্যালোচনা করার সময় এসেছে। তাই সরকারপক্ষ মনে করে, পর্যালোচনার পরই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা যাবে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও অপপ্রয়োগ বন্ধে আইনটি পর্যালোচনার পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এ আইনটি অত্যন্ত সময়োপযোগী আইন। আমরা তো শুরুতেই বলেছি, অপপ্রয়োগ বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া হবে। এটা সব আইনের ক্ষেত্রেই করা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘যেকোনো আইন প্রণয়ন করা হলে এর প্রায়োগিক দিকগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে যায়। এ আইনের ক্ষেত্রে সেই রকম কিছু ঘটলে আমরা ব্যবস্থা নেব। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সঙ্গে আইনটি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে।’
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আইনের পর্যালোচনায় আমরা বিশ্বের এ ধরনের অন্যান্য আইনের সঙ্গে তুলনা করছি। আমরা সব বিশ্লেষণ করে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স রেখেই ব্যবস্থা নেব।’
এদিকে গতকাল আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘এ আইনে কোনো অপরাধের অভিযোগ এলে পুলিশের তদন্তের আগে কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না বা তার বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া যাবে না এমন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
এ আইনে নয় মাস ধরে আটক থাকা লেখক মুশতাক আহমেদ ছয়বার আবেদন করেও জামিন পাননিএ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সাজা যতটা হলে জামিন হবে এবং যতটা হলে জামিন হবে নাঠিক সেই প্রিন্সিপালটা ফলো করে আমরা বিধান করেছি। সারা পৃথিবীতেই এটা করা হয়। এমনকি এই উপমহাদেশেও। বিষয়টা নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করছি।’ তবে এসব ব্যবস্থা নিতে আইনের সংশোধনের প্রয়োজন নাও হতে পারে এবং বিধির মাধ্যমে সেটা করা যেতে পারে বলে মত দেন তিনি।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে দশম জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়। সেই সময়েও গণমাধ্যম এবং মানবাধিকারকর্মীরা আইনটির অজামিনযোগ্য ধারা, অভিযোগের পর পুলিশি তদন্ত ছাড়াই গ্রেপ্তারসহ অনেক ধারায় আইনের অপপ্রয়োগ এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে হয়রানির আশঙ্কা করেন। এ আইনের মামলায় গ্রেপ্তার লেখক মুশতাকের গত বৃহস্পতিবার কারাগারে মৃত্যুর পর দাবিগুলো আরও জোরালো হয়।
এদিকে আইনটির অপপ্রয়োগ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, তদন্ত ছাড়া গ্রেপ্তারের বিধানে এ আইনটির অপপ্রয়োগ হচ্ছে কিছুটা। অনেকেই অনেক ধরনের সুযোগ নিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে অতি উৎসাহীদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে।
কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ এবং এ মাধ্যমে অপরাধও বাড়ছে। আমি মনে করি এ প্রেক্ষাপটে আইনটির প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। এখন আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে কি না সেটা দেখতে হবে। কিন্তু আইন বাতিলের প্রসঙ্গ কেন আসবে?’
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘সবকিছুর জন্য আদালতের দরজা খোলা রয়েছে। কোনো প্রেক্ষাপটে অভিযোগের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেপ্তার করতে হয়। সেখানে তদন্তের সুযোগ থাকে না। কিংবা আইনও শক্ত হতে পারে। কিন্তু সেখানে আদালতের দরজা খোলা রয়েছে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অজামিনযোগ্য ধারার বিষয়ে এ সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এখানে আদালতের দরজা খোলা রয়েছে। যে কেউ চাইলে আদালতে রিট করে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। কাজেই আইন যত শক্তই হোক না কেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আদালতের দরজা খোলা রয়েছে।’
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়ে ব্যারিস্টার শফিক বলেন, ‘আমাদের দেশের জন্য উপযোগী আইন আমরাই বিশ্লেষণ করে ঠিক করব। অপপ্রয়োগ এবং হয়রানি বন্ধে আইন নিয়ে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতেই পারে।’
এ আইনের ষষ্ঠ অধ্যায়ে সাইবারসংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সবই আমলযোগ্য এবং অজামিনযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এ আইনে। আইনটির ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ ধারায় উল্লিখিত অপরাধসমূহ আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য বলে বিবেচিত বলা হয়েছে। তবে ২০, ২৫, ২৯ ও ৪৭ ধারার অপরাধসমূহ অ-আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য হবে। আইনের ২১ (১) ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালালে কিংবা এতে কেউ মদদ দিলে দুজনের কার্যক্রম একই অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ অপরাধে সংশ্লিষ্ট আসামির সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড হবে। একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৩ কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন আসামি।