মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছি ড. সা’দত হোসাইন স্যারের মৃত্যুতে অনেকে স্মৃতিচারণ করছেন তিনি কিভাবে বিসিএস জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়েছেন বা হননি তার গল্প। যিনি বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন বা হতে পারেননি সকলেই এই মহান মানুষটির মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত। সকলেই উনাকে ভালো বলছেন এবং তিনি যে বিসিএস পরীক্ষা ও পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন তা একবাক্যে স্বীকার করছেন। কীর্তিমানের মৃত্যু নাই। আসলেই তাই। যিনি গতকাল না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি তাঁর কর্মের মধ্য দিয়ে হাজার বছর বেঁচে থাকবেন তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এই মানুষটির কিছু ব্যক্তিগত তথ্য- উপাত্ত ও জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরবো তাতে করে তাঁর সম্পর্কে এই প্রজন্মের অনেকে জানতে পারবে।
ড. সা’দত হুসাইন (২৪ নভেম্বর ১৯৪৬ – ২২ এপ্রিল ২০২০) ছিলেন একজন বাংলাদেশী আমলা এবং দেশের অন্যতম প্রধান সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন চেয়ারম্যান।এছাড়া তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রধান তথা বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীপরিষদ সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
ড. হুসাইন একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ এর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারে তিনি কাজ করেছিলেন। চাকুরী জীবনে তিনি সততা, কর্মদক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তিনি ছিলেন নিয়মানুবর্তী ও নীতিপরায়ণ।
ড. সা’দত হুসাইন ১৯৪৬ সালের ২৪শে নভেম্বর নোয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। তার এক পুত্র – শাহজেদ সা’দত, এবং দুই কন্যা রয়েছে।
কর্মজীবনঃ শিক্ষাজীবন শেষে পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) যোগ দেন। ১৯৭১ তিনি নড়াইলে শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তিনি এপ্রিল মাসে ভারত গমন করেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে তাঁর গ্রন্থ “মুক্তিযুদ্ধের দিন-দিনান্ত’’ মাওলা ব্রাদার্স কর্তৃক ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়।
তিনি ২০০২-২০০৫ মেয়াদে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস থেকে যথারীতি অবসর গ্রহণ করেন। ২০০৭ সালে তিনি বাংলাদেশ পাবলিক কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্তি লাভ করেন এবং ২০১১ পর্যন্ত এ পদের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকুরি করেছেন। চাকুরী জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী সা’দত হুসেন ছিলেন বাংলাদেশের সরকারি চাকুরীর জন্য নিয়োগ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন -এর নবম চেয়ারম্যান। তিনি ২০০৭ সালের ৯ মে তারিখে তিনি চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব লাভ করেন এবং ২০১১ সালের ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। তিনি একজন সৎ, নির্ভীক ও সাহসী সরকারি আমলা ছিলেন। তাকেঁ আজীবন মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।(তথ্যসূত্রঃ উকিপিডিয়া)
একজন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা মাহবুব আলম তার ফেসবুকে লিখেছেন, ড. সাদাত স্যারকে প্রথম দেখি বিসিএস ভাইভা দিতে গিয়ে। পুরাতন পিএসসি ভবনের ফটকে কার থেকে নেমে ডানামেলা বিহঙ্গের মত হন হন করে উপরে উঠে গেলেন। স্যারের সময়ে চাকুরি হল। এরপর স্যারকে শুধু টকশোতে শুনেছি, দেখেছি। তাঁর স্তুতি, সততা, দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্ব আর সফলতার গল্প শুনে পরবর্তীকাল কেটেছে। স্যার চলে গেলেন না ফেরার দেশে। প্রশাসন পরিবারে এমন অভিভাবকের শুন্যতা অপূরণীয়। আল্লাহ তাঁকে জান্নাত দিন।
মনিরুজ্জামান মনির, তিনি শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন স্যার পি এস সি এর চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে আমি বি সি এস পরীক্ষার ভাইভা দিয়েছিলাম। আল্লাহ্র অশেষ রহমতে আমার চাকরি ও হয়েছিল। আমার মতো অসংখ্য বেকার তরুণ স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। স্যার বি সি এস পরীক্ষার ধরনটাই পাল্টে দিয়েছিলেন। আল্লাহ স্যার কে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন।
একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন এভাবে, চলে গেলেন এদেশের অনুকরণীয় একজন সৎ, সজ্জন ও দক্ষ সাবেক মণ্ত্রিপরিষদ সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. সা’দত হুসাইন স্যার । ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। তিনি ছিলেন যেমন জ্ঞানী তেমনি বিনয়ী মানুষ। মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন।
মেহেরপুর জেলা কমিউনিটি ক্লাব ঢাকা’র বিকলুস আহমেদ বিশ্বাস তিনি শোক বার্তায় ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, সাবেক মন্ত্রী পরিষদ সচিব ও পিএসসি’র চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইন আর নেই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। গত কয়েকদিন থেকে তিনি খুবই অসুস্থ ছিলেন। ইউনাইটেড হাসপাতালে তাকে ভেন্টিলেটর সাপোর্টে রাখা হয়েছিলো। আজ রাত সাড়ে দশটার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। অত্যন্ত সজ্জন ও সত্যবাদী ড. সা’দত হুসাইন সাবেক সিনিয়র সচিব ছিলেন। টকশোতে তিনি ছিলেন সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। যেকোনো আলোচকের চেয়ে তার বলার কৌশল ছিলো অনেক জ্ঞান ও তথ্য সমৃদ্ধ। অত্যন্ত নিরহঙ্কার, সৎ ও ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। দেশ ও জাতি একজন মেধাবী সত্যবাদী মানুষকে হারালো। তারা মরহুম ড. সা’দত হুসাইন এর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন।
মোহাম্মদ হোসোইন রেজা কাদেরী একটি কমেন্টেস এ লিখলেন এভাবে, কালেরকণ্ঠে তারঁ লেখা নিবন্ধ পড়েছি।অনেক বড় মাপের লেখক ও গবেষক ছিলেন।আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুণ! তারঁ পরিবারকে নিরাপদে রাখুন। আমিন!
কালের কন্ঠ পত্রিকার লেখায় তাঁকে স্তুতি করে লেখা হয়েছে, সরকারি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভের পর থেকে ড. সা’দত হুসাইন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়মিত লিখেছেন দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায়। এছাড়া তিনি বিভিন্ন ধরনের সমাজ উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এছাড়া বিভিন্নজন এই সাবেক আমলা সম্পর্কে সব বিষয়ে ইতিবাচক (পজিটিভ) মন্তব্য করেছেন। মানুষ যা ভাবেন আমরা বিশ্বাস করি মহান আল্লাহ ঠিক সেরকমই প্রতিদান দেবেন। উনি মারা গিয়েছেন কিন্তু কর্মফল রেখে গেছেন। এখনকার আমলা ও সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য অনেক আদর্শ রেখে গেছেন। তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেলেন একজন সরকারী কর্মকর্তা হিসাবে দল-মত নির্বিশেষে সকলের নিকটে গ্রহণ যোগ্য ব্যাক্তিতে পরিণত হতে হয়। উনি বিসিএস ক্যাডারদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। যা সত্যিই অনেকেই সেটা করতে পারেন নাই। উনি তার জাগতিক কর্মকান্ডের মধ্যদিয়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করেছেন। তাঁর আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে ও ভবিষ্যত প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে জীবনীগ্রন্থ লেখা যেতে পারে। তাহলে এই সব সৃস্টিশীল মানুষ আরো অনেকদিন তাঁর কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকবে। পরম করুনাময় মহান আল্লাহ মরহুম সা’দত হুসাইনকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।
লেখকঃ কলামিস্ট, গবেষক ও আইন বিশ্লেষক। ইমেইলঃ bdjdj1984du@gmail.com.