ভার্চুয়াল মুদ্রা ‘বিট কয়েন’ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও থেমে নেই কেনাবেচা। অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার পথ হিসেবে এর কদর বেড়েছে অনেক বিত্তবানের কাছে। এরই সুযোগ নিয়ে গড়ে উঠেছে একাধিক অসাধু চক্র। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি থেকে রাজনীতিকরা এ চক্রে নাম লিখিয়েছেন। তারা বিট কয়েন কেনার নামে হুন্ডির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচার করছেন।
ব্লক চেইন, বিনান্স, কয়েন বিগো নামের বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে ভার্চুয়ালি কেনাবেচা হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়া সহজ হচ্ছে। তবে বিট কয়েনের কেনাবেচা বেড়ে যাওয়ায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাও নজরদারি বাড়ায়। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি পৃথক চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকা থেকে বিট কয়েন কেনাবেচার সময় মো. মাহমুদুর রহমান জুয়েলকে (২৭) গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তেজগাঁও বিভাগ। আর গত ১২ জানুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানা এলাকা থেকে মো. রায়হান হোসেনকে (২৯) গ্রেপ্তার করে র্যাব।
এ বিষয়ে ডিবি তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) গোলাম মোস্তফা রাসেল জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী বাংলাদেশে বিট কয়েন নিষিদ্ধ। এটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কেনাবেচা হয় এবং এদেশে নিষিদ্ধ বলে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় চক্রের সদস্য জুয়েলকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার থেকে বিট কয়েনের হিসাব (অ্যাকাউন্ট) এবং লেনদেন সংক্রান্ত দুটি ডিভাইস জব্দ করা হয়। জুয়েল ২০১৬ সালে মালয়েশিয়া থাকাকালে বিট কয়েন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। প্রাথমিকভাবে তিনি ২১ হাজার ডলার লেনদেনের তথ্য দিয়েছেন এবং এক আত্মীয়ের মাধ্যমে বিট কয়েন কেনেন। অর্থ পাচার ও অবৈধ লেনদেনের জন্য বিট কয়েন কেনাবেচা একটি সহজ মাধ্যম। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। জুয়েলকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও কিছু নাম পাওয়া গেছে। তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিট কয়েন ভার্চুয়াল মুদ্রা। এটি ক্রিপটোকারেন্সি নামেও পরিচিত। বিট কয়েন ছাড়া টিআরওএক্স, এক্সআরপি, এডিএ নামে কিছু ক্রিপটোকারেন্সি এদেশে ব্যবহার হচ্ছে। অসাধু চক্রের সদস্যরা তিনটি অ্যাপসের মাধ্যমে লেনদেন করেন। অ্যাপসে গেলেই তারা ক্রেতা-বিক্রেতা সম্পর্কে জানতে পারেন। অন্যান্য মুদ্রা লেনদেনে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক জড়িত থাকে। কিন্তু বিট কয়েনে এমন কোনো কর্র্তৃপক্ষ নেই। বিশ্বের কিছু দেশে বিট কয়েন কেনাবেচা বৈধ থাকলেও ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকার নিষিদ্ধ করে। দুই মাস আগে একটি বিট কয়েনের দাম ছিল ১৯-২১ হাজার ডলার। তবে গতকাল মঙ্গলবার এটির দাম ৪৬ হাজার ৬০০ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪০ লাখ) দেখা যায়।
ডিবির তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, জিজ্ঞাসাবাদে এমএলএম ব্যবসার মাধ্যমে জুয়েল মানুষ থেকে অর্থ হাতিয়ে বিট কয়েন ব্যবসা শুরু করেন। ৭-৮ লাখ টাকা পুঁজিতে শুরু করলেও এখন তার ব্যবসা ৭০-৮০ লাখ টাকার। তবে অ্যাপসে জুয়েলের লেনদেন দেখে এ অঙ্ক কোটি টাকার ওপরে মনে হয়েছে। তিনি হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করেছেন। জুয়েলের মুঠোফোন বিশ্লেষণ করেও বিভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি দুবাই ও মালয়েশিয়া থেকে বিট কয়েন কিনতেন। অসংখ্যবার ভারত যাওয়ার তথ্যও পাওয়া গেছে। মূলত বিট কয়েন ভাঙানোর প্রয়োজন হলে তিনি ভারত যেতেন। রনি নামে জুয়েলের এক সহযোগী রয়েছেন। পুলিশ তার বিষয়েও অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কিছু ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও রাজনীতিকের সঙ্গে জুয়েলের বিট কয়েন কেনাবেচার তথ্য পাওয়া গেছে। অবৈধ টাকা দিয়ে বিট কয়েন কিনে তা ব্যবহার করে বাইরে থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র এনেছেন অনেক শিল্পপতি। এদের তালিকা করা হবে। জুয়েলের ব্যাংক হিসাবগুলোও খতিয়ে দেখা হবে।’