গত বছরের ১৫ জুলাই। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাস দুমড়েমুচড়ে নিহত হয় বর-কনেসহ ১১ জন। ক্রসিংটি ছিল অরক্ষিত। ওই দুর্ঘটনার পর ট্রেন আটকে রাখার ঘটনা ঘটেছিল। হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনের পর রুল জারি করা হয়েছিল। এরপর ওই ক্রসিংয়ে একজন গেটম্যান নিয়োগ দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে রুল জারির পরও দৃশ্যত দুর্ঘটনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
গত ১০ ডিসেম্বর। জয়পুরহাট সদরের পুরানপৈল লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেন-বাস সংঘর্ষে নিহত হয়েছে ১২ বাসযাত্রী। এই ক্রসিংটি সংরক্ষিত হলেও রেলরক্ষী কর্মস্থলে উপস্থিত না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটে বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। তার ভিত্তিতে ওই রেলরক্ষী বা গেটম্যানকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
গত দুই বছরে ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে অন্য যানবাহনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ৫৬টি। এতে প্রাণহানির সংখ্যা ৮৪। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, দুর্ঘটনা কমাতে হলে অবৈধ ক্রসিং বন্ধ করতে হবে। সে জন্য দুর্ঘটনার দায় তাদের একার নয়। অবৈধ ক্রসিং বন্ধের চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না। কারণ যারা অবৈধ ক্রসিং তৈরি করেছে, তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী।
রেলের হিসাবে, দেশে তিন হাজার কিলোমিটার রেলপথে লেভেলক্রসিং রয়েছে তিন হাজার ৩৯৮টি। লেভেলক্রসিং হলো রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া সড়কের সংযোগস্থল। এসব সংযোগস্থল রক্ষিত (পাহারাদার আছে), অরক্ষিত (পাহারাদার নেই), বৈধ ও অবৈধ—এভাবে ভাগ করে রেল কর্তৃপক্ষ। রক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেন আসার সংকেত পেয়ে প্রতিবন্ধক দিয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা থাকে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব ড. সৈয়দা নওশীন পর্ণিনী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুর্ঘটনা কমাতে হলে সবার আগে অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধ করতে হবে। কিন্তু যারা এই অবৈধ ক্রসিং গড়ে তুলেছে তারা স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং খুবই প্রভাবশালী। ফলে তা বন্ধ করা যাচ্ছে না। আইনি জটিলতা ও ব্যবস্থা নিতে ধীরগতি তো রয়েছেই।’ দুর্ঘটনা তদন্ত হলেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তদন্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া রেল কর্তৃপক্ষের কাজ, মন্ত্রণালয়ের না। আমরা তদন্ত করে বিভিন্ন সুপারিশ দিয়ে থাকি।’
রেলভবন সূত্র বলছে, তদন্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রায় অসম্ভব। কেননা ঘটনার মূলে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা সবাই হয় স্থানীয় রাজনীতিতে দলীয়ভাবে প্রভাবশালী, না হয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। এ জন্য বহু টালবাহানার পর তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়লেও এর বাস্তবায়ন দেখা যায় না।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে তিন হাজার কিলোমিটার রেলপথে থাকা তিন হাজার ৩৯৮টি ক্রসিংয়ের মধ্যে এক হাজার ৩৬১টি অবৈধ। আর বৈধ-অবৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে অরক্ষিত দুই হাজার ৫৪টি। অবৈধ ক্রসিংয়ের বেশির ভাগেই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) রাস্তা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাম্প্রতিক সময়ের এক গবেষণার তথ্য বলছে, দেশের মোট অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ ও এলজিইডির রাস্তা রয়েছে ৪২৭টি করে, সড়ক ও জনপথ বিভাগের ২৪, পৌরসভার ১১০, সিটি করপোরেশনের ৩২, একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ২৭, জেলা পরিষদের ১৩ ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তিনটি। এ ছাড়া ১২৭টি ক্রসিং কাদের অধীনে আছে তা জানাই যায়নি।
এআরআই বলছে, বৈধ লেভেলক্রসিংয়েই স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে গেটম্যানের ৩১৪ পদ শূন্য রয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ এসংক্রান্ত হিসাব না দিলেও বলেছে, করোনার কারণে নিয়োগ আটকে আছে। দ্রুত এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হবে।
এআরআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছরে রেলপথে ৮৫৫ দুর্ঘটনায় ৯০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর সঙ্গে জয়পুরহাট ও দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর মৃত্যুর তথ্য যোগ করলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৯১৮। ২০১৮ সালে ২৩৫ দুর্ঘটনায় ২৪৪ জন মারা গেছে এবং ২২৮ জন আহত হয়েছে। এর আগের বছর ২১১টি দুর্ঘটনায় ২২৯ জন মারা যায় এবং ১৫৫ জন আহত হয়। ২০১৬ সালে ৫৬টি দুর্ঘটনায় ৫৯ জন মারা যায় এবং ৪৬ জন আহত হয়। গত বছর ২২৮ দুর্ঘটনায় ২৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে ৪৭২ জন। এর মধ্যে লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৫টি, যেখানে ৪৭ জন মারা গেছে, আর আহত হয়েছে ৬০ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১২৭টি ট্রেন দুর্ঘটনায় ১৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে ৩১ জন। এরই মধ্যে লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২১টি, যেখানে ৩৭ জন মারা গেছে আর আহত হয়েছে ২৬ জন।
অরক্ষিত ক্রসিংয়ে রেল কর্তৃপক্ষ সতর্কীকরণ নোটিশ টাঙিয়ে দিয়ে দায় সারে। রক্ষিত ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটির সুপারিশের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয় না।
রেলের যুগ্ম মহাপরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্থানীয় সুবিধাভোগীরা কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই লেভেলক্রসিং তৈরি করছে। এমনকি পরে সেগুলো তাদের দেখভাল করার কথা থাকলেও তারা করছে না। এমন পরিস্থিতিতে ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার দায় শুধু রেলের ওপর পড়ে না। দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর দায় যদি নিতে হয় তাহলে সবার নিতে হবে।’ অবৈধ ক্রসিং বৈধ করার উদ্যোগ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ‘আপনার পরিবারের সদস্য বেড়ে গেলে তা মেইনটেন করা কঠিন হবে নিশ্চয়ই।’
অনুমোদনের বিষয়টি হলো সংশ্লিষ্ট সংস্থা রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণের সময় রেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়েছে। ক্রসিংগুলোতে প্রতিবন্ধক ও অবকাঠামো তৈরি এবং কর্মী নিয়োগের পর ১০ বছরের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ দেওয়ার পরই অনুমতি পাওয়া যায়। ফলে অনুমোদিত ক্রসিং সুরক্ষিত রাখা রেলের দায়িত্ব।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ ক্রসিংয়ের বিষয়ে গত ২৯ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগের সঙ্গে রেল কর্তৃপক্ষের একটি বৈঠক হয়েছে। সমস্যা নিয়ে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
রেলের যুগ্ম মহাপরিচালক শহীদুল ইসলাম বলছে, রেল মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই ১৬ প্রতিষ্ঠান রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করেছে। এতে দুর্ঘটনা ঘটলে দায়দায়িত্ব আসে রেলওয়ের ওপর। তিনি আরো বলেন, অবৈধ ক্রসিং বন্ধের ব্যাপারে তাঁদের চেষ্টার কমতি নেই। বহু মামলা করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।
রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান বলেন, ‘রেলে দুর্ঘটনার দায় রেলের নয়। রেল রেলের পথেই চলে। লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সবার আগে দায়ী বাসের চালক। তাঁর ক্রসিং পার হওয়ার আগে দেখা উচিত। এরপর দায় আসে গেটম্যানের ওপর। আর আইন না মানার মানসিকতা এবং মানুষের অসহিংসতা তো আছেই। লক্ষ করলে দেখা যাবে, যেসব লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যান নেই এবং দুর্ঘটনা হচ্ছে, সে সবের ৯৯ শতাংশই অবৈধ ক্রসিং। তাই রেলের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ নেই।’
গত বছর ১৫ জুলাই সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় দুর্ঘটনার পর ২৮ জুলাই অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধ চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন মানবাধিকার সংগঠন ‘ল অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশন’-এর পক্ষে ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব। আবেদন শুনানি করে আদালত রুল জারি করেন। এতে সারা দেশের লেভেলক্রসিংয়ের সীমানা চিহ্নিত করে লোহার প্রতিবন্ধকসহ প্রতিটি ক্রসিংয়ে গেট নির্মাণ ও গেটম্যান নিয়োগ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল। প্রায় দেড় বছর পার হয়ে গেলেও অবস্থার উন্নতি দেখছেন না রিটকারী হুমায়ুন কবির পল্লব। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, হাইকোর্টের রুলেও কারো টনক নড়েনি। এমনকি ১১ জনের মৃত্যুর ঘটনায় হওয়া মামলারও তেমন গতি নেই। বিচার হয় না বলে প্রভাবশালীরা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠেন।’
রেলপথে দুর্ঘটনার জন্য রেলওয়ের বেশি দায় দেখছেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘রেলের উদাসীনতা ও সমন্বয়হীনতা দুর্ঘটনার মূল কারণ। কারণ যে আইন আছে তাতে রেল কর্তৃপক্ষ চাইলে রেলপথের নির্দিষ্ট সীমায় কারো ঢুকতে পারার কথা নয়। একইভাবে রেল যদি শক্ত অবস্থান নিত, তাহলে অবৈধ ক্রসিং গড়ে উঠতে পারত না।’
দুর্ঘটনা কমানোর উপায় সম্পর্কে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের ক্রসিংগুলো এখনো সনাতন পদ্ধতিতেই চলছে। সময় এসেছে আধুনিক করার। আমরা তো বলছি, দেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। তাহলে ক্রসিংয়ে কেন ডিজিটালের ছোঁয়া নেই।’ তিনি বলছেন, ক্রসিংয়ে ১৫০ মিটার আগে থেকে ৫০ মিটার অন্তর অন্তর একসঙ্গে একাধিক গতি রোধক দিতে হবে। রেলক্রসিংয়ের সামনে জ্বলজ্বল করে এমন বাতি বসাতে হবে। ট্রেনের সামনেও অতিরিক্ত বাতি থাকতে হবে যে প্রয়োজনে তা ব্যবহার করা যায়। এতে করে ৮-৩০ শতাংশ দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন।