মোঃ জিয়াউর রহমান:
করোনা তার থাবা বিস্তার করে চলছে। বিশ্বের অন্য যে কোন প্রান্তের মতই আমরাও আজ করোনাক্রান্ত এবং বিদ্যমান বাস্তবতায় দিনে দিনে এর প্রকোপ বেশী হওয়ার সম্ভাবনা। আমাদের কারাগারগুলোতে [মোট কারাগার ৬৮টি, কেন্দ্রীয় কারাগার ১৩টি এবং জেলা কারাগার ৫৫টি] ধারন ক্ষমতার দ্বিগুণের বেশী হাজতী [Under Trial Prisoner- মামলার রায় হয়নি, বিচারাধীন মামলার আসামী] ও কয়েদী [Convicted Prisoner- বিচার শেষে শাস্তি হয়েছে] রয়েছে।
স্বল্প পরিসর ও পরিবেশের কারণে তাদের বার বার হাত ধোয়া ও পৃথক থাকার সুযোগ কম। এমন পরিপ্রেক্ষিতে কোন বন্দী (Inmate) করোনায় আক্রান্ত হলে অন্যদের মধ্যে সহজে সংক্রমিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ এই বিপর্যয়ে তাদের বন্দীদের সাময়িক মুক্তি দিচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতের সুপ্রীম কোর্ট ৭ বছর পর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী এবং ৭ বছর পর্যন্ত দন্ডযোগ্য অপরাধে অাটক হাজতীকে পারোল অথবা জামিনে মুক্তি দিতে নির্দেশ দিয়েছে এবং নির্দেশনা মোতাবেক প্রত্যেক রাজ্যে একটা কমিটি এই মুক্তি প্রক্রিয়া দেখছে।
নিউজ পেপারে এসেছে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও ইতোমধ্যে বন্দী মুক্তির জন্য জরুরী পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন, এ বিষয়ে কাজ চলছে।
মূলতঃ কোর্ট কোন দণ্ডাদেশ দিলেও রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে চূড়ান্ত হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও সরকার এই (বন্দী মুক্তি) Prerogative Power চর্চা করতে পারে।
১. রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক Clemency ক্ষমতাঃ আমাদের বিদ্যমান আইনে সুপ্রীম ল হলো আমাদের Constitution. এই পবিত্র সংবিধানের আর্টিকেল ৪৯ তে Prerogative of Mercy হিসেবে Clemency এর ক্ষমতা মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপর অর্পিত হয়েছে। এখানে বলা আছে, ” The President shall have power to grant pardons, reprieves and respites and to remit, suspend or commute any sentence passed by any court, tribunal or other authority. ” এই আর্টিকেলে ব্যবহৃত প্রতিটি লিগ্যাল টার্ম স্বতন্ত্র অর্থ বহন করে। Pardon হলো এমন ক্ষমা যা দন্ডিতের দন্ড, শাস্তি এবং সকল অযোগ্যতাকে দূর করে দেয়। Reprieve হলো শাস্তি (মূলতঃ মৃত্যুদন্ড) সাময়িক স্থগিত রাখা। Respite হলো বিশেষ শারীরিক পরিস্থিতির কারণে (যেমন কোন মহিলার গর্ভাবস্থার কারনে) মূল দন্ডের স্থলে তুলনামূলক কম (lesser) শাস্তি আরোপ করা। Remit অর্থ শাস্তির প্রকৃতি ঠিক রেখে মেয়াদ কমানো (যেমন ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এর পরিবর্তে ১ বছর সশ্রম কারাদণ্ড)। Suspend হলো সাময়িক ভাবে কোন কার্যকারিতা স্থগিত রাখা। Commute মানে শাস্তির প্রকৃতি পরিবর্তন করে কম শাস্তি আরোপ করা (যেমন মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন, সশ্রম স্থলে বিনাশ্রম)।
২. সরকারের আইনগত ক্ষমতাঃ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংবিধানে অন্তর্ভুক্তিরও বহু পূর্বে CrPC তে সরকারকে বন্দী মুক্তির ক্ষমতা Incorporate করা হয়েছিল। CrPC এর ৪০১(১) ধারায় বলা আছে, সরকার যে কোন সময় শর্ত সাপেক্ষে বা বিনা শর্তে কারও উপর আরোপিত শাস্তির কার্যকারিতা Suspend (স্থগিত) অথবা পুরো বা আংশিক মেয়াদ Remit (কমানো) করতে পারে। কেউ এমন দরখাস্ত দিলে এক্ষেত্রে সরকার সংশ্লিষ্ট জাজ এর অ চাইতে পারে [Section 401(2)]. সরকার কোন শর্তারোপ করলে এবং তা অমান্য করলে Suspension বা Remission সরকার বাতিল করতে পারে এবং পুলিশ সে ব্যক্তিকে এরেস্ট করে বাঁকি শাস্তি ভোগে বাধ্য করতে পারবে [Section 401(3)]. CrPC এর ৪০২ ধারা মতে সরকার দন্ডিতের মতামত না নিয়েই মৃত্যুদন্ড এবং সশ্রম কারাদণ্ড কে Commute করতে পারবে। CrPC এর 402 A অনুযায়ী সরকারের এই ক্ষমতা মহামান্য রাষ্ট্রপতিরও থাকবে।
৩. কারা কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাঃ এছাড়া জেল কোডেও বন্দীমুক্তির বিধান আছে। জেল কোড এর ৫৯৪ ধারা অনুযায়ী কোন বন্দী যদি এমন ভাবে অক্ষম হয়ে পরে (যেমন অন্ধত্ব) যে তার পক্ষে অপরাধে জড়ানো সম্ভব নয় তাহলে জেল সুপার আইজি প্রিজন কে লিখবে এবং আইজি প্রিজন সরকারের আদেশে তাকে মুক্তি দিতে পারবেন। এছাড়া জেল কোড এর ৫৬৯ ধারা মতে ধর্মীয় বা রাষ্ট্রীয় উৎসব উপলক্ষ্যে দীর্ঘ মেয়াদী বন্দীদের ক্ষেত্রে ১৪ বছর বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্তদের ক্ষেত্রে ২০ বছর অতিক্রম হলে তাদের কে Remit করে মুক্তির ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। জেল কোড এর এই বিধান মতে ২০১০ সনে আগস্ট মাসে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সহ প্রায় ১০০০ বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
এই যে প্রক্রিয়ার কথা বললাম, এগুলোতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের অনুমোদনের বিষয় জড়িত। স্বাভাবিক ভাবেই এক দপ্তর হতে অন্য দপ্তর হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগবে। তাই সংক্ষেপে দ্রুত সময়ে কাজ করার জন্য একটা নীতিমালা দরকার যাতে জেলা ভিত্তিক একটি কমিটি কাজ করতে পারে। ভারতের মত আমাদের এখানেও একটা বর্ডার লাইন (৭ বছর কারাদণ্ড প্রাপ্ত অথবা ৭ বছর পর্যন্ত শাস্তিযোগ্য) ফিক্সড করা দরকার।
তুলনামূলক সহজ ও সাময়িক পদ্ধতিঃ
১. প্যারোলঃ দ্রুত সময়ে বন্দী মুক্তির ক্ষেত্রে প্যারোল হতে পারে সর্বোত্তম পদ্ধতি। আমাদের একটা প্যারোল নীতিমালা আছে (২০১০)। প্যারোল হলো বিশেষ প্রয়োজনে বন্দীর সাময়িক মুক্তি। কোন বন্দীর নিকট আত্মীয় মারা গেলে ১২ ঘন্টার জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাধারণত প্যারোল দিতে পারে। তবে সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্তে এর চেয়ে বেশী সময়ের জন্য প্যারোল দেয়া যেতে পারে [ ক(১)(খ)] এ ক্ষেত্রে করোনার কারনে সরকার ৩ মাস বা ৬ মাস সময়ের জন্য এমন প্যারোল ঘোষণা করতে পারে। প্যারোল সময় শেষে প্যারোল গ্রহীতাকে আবার কারাগারে প্রবেশ করতে হবে।
২. প্রবেসনঃ ১ বছরের বেশী সময়ের জন্য শাস্তি প্রাপ্ত নারী বন্দীদের মধ্যে যারা রেয়াতসহ ৫০% কারাদণ্ড ভোগ করেছে তারা প্রবেসন পেতে পারে। এটা সরকারের সিদ্ধান্তে হতে পারে। অন্য ক্ষেত্রে কোর্ট কর্তৃক রায় ঘোষণাকালে প্রবেসন দেয়া হয় বলে ইতিমধ্যে শাস্তি ভোগরতদের জন্য প্রবেসন দেওয়ার আইনগত সুযোগ নেই।
৩. জামিনঃ বর্তমানে ক্রান্তিকাল চলছে। জাতির প্রয়োজনে কল্যাণকর যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট খোলা আছে, সেখানে জরুরি বিষয়গুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে। জনকল্যাণমুখী সরকার ও অভিভাবক হিসেবে মাননীয় সুপ্রীম কোর্ট মিলে ভারতের মত করেই আমাদের দেশেও একটা স্টান্ডার্ড ফিক্সড করে দিতে পারে। যারা সেই স্টান্ডার্ড এর আওতায় পরবে, তারা জামিন পাবে।
তবে ক্রান্তিকালে গড়পড়তা সবাইকে এই সুযোগ দেয়া সমীচীন নয়। হত্যা, ধর্ষণ, যুদ্ধাপরাধ, ডাকাতি, এসিড নিক্ষেপ, মাদক সহ খারাপ ধরনের অভিযোগে আটক ও শাস্তিপ্রাপ্তদের জন্য এমন সুযোগ না দেওয়া উত্তম, নইলে আইন শৃঙ্খলার অবনতির যুক্তিসঙ্গত আশংকা থাকবে।
দেশের প্রতিটি নাগরিক নিরাপদ থাকুক- এই হলো প্রত্যাশা।
লেখক- চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মাগুরা।
judgezia@gmail.com