জমি সংক্রান্ত মামলার রায়, ডিক্রি ও আদেশের নিষ্পত্তির জন্য ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে ভূমি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
এ বিষয়ে প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে রায়ের আদেশ বাস্তবায়ন করে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে হলফনামা দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জারি করা এ সংক্রান্ত একটি রুল যথাযথ ঘোষণা করে গত বছরের ২৫ জুলাই সংক্ষিপ্ত রায় দিয়েছিল বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাই কোর্ট বেঞ্চ। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিস্তারিত নির্দেশনাগুলো এসেছে।
রায়ের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ২০০৪ সাল থেকে গত বছর পর্যন্ত দীর্ঘ ১৫ বছরে ভূমি মন্ত্রণালয় আপিল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করতে না পারায় লাখ লাখ মানুষ ‘চরম ও সীমাহীন দুর্ভোগে’ নিমজ্জিত হয়েছে।
“যেখানে জাতির পিতা সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন সাধারণ জনগণকে হয়রানিমুক্ত বিচার প্রদানের জন্য, যেখানে জাতির জনক যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে জাতীয় সকল গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি শাসনতন্ত্র তথা সংবিধানের মত গুরুত্বপূর্ণ আইন ৯ মাস সময়ের মধ্যে প্রণয়ন করেছেন, সেখানে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে একটি ‘এক পাতার’ প্রজ্ঞাপন করতে না পারা ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং সচিবের চরম ব্যর্থতা।”
আদালত বলেছে, সরকার নিজের আইন নিজে যথাযথ এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে, এটাই ‘সকলের কাম্য’।
“সাধারণ জনগণ যাদের জন্য দীর্ঘ ১৫ বছর এ ভোগান্তি ভোগ করল, তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে, দাঁড়াতে হবে জনগণের কাঠগড়ায়।”
সংবিধানের প্রস্তাবনায় তৃতীয় পর্যায় থেকে উদ্ধৃত করে রায়ে বলা হয়, রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্ধনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে।
“সংবিধানের ৭(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এদেশের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। সেই মালিককে তথা জনগণকে ২০০৪ সাল থেকে দীর্ঘ ১৫ বছর যাবত হয়রানি করে চলেছে ভূমি মন্ত্রণালয়।”
১৫ বছর ধরে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে না পারার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করা মন্ত্রী-সচিবদের কৈফিয়ত চাওয়ার কথা বলা হয়েছে রায়ের পর্যালোচনায়।
সেখানে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছর ধরে ভূমি মন্ত্রণালয় এদেশের মালিক জনগণকে তার আইনসম্মত প্রাপ্য অধিকার থেকে, তথা আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল মামলা দায়েরের অধিকার থেকে ‘বঞ্চিত করে চলেছে’। ফলে জনগণের মৌলিক অধিকার যেমন লঙ্ঘিত হচ্ছে, তেমনি জনগণ সুবিচার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
“ভূমি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিবরা আপিল ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিয়োগ না করে জনগণের সাথে অমানবিক, নিষ্ঠুর এবং ক্ষমার অযোগ্য আচরণ করেছেন।
“অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট সকল দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ও সচিবের কাছ থেকে লিখিত আকারে এ বিষয়ে কৈফিয়ত নিয়ে বর্তমান মন্ত্রী ও সচিব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা জনগণের পক্ষে গ্রহণ করবেন।”
মামলাটি চলমান (কন্টিনিউয়াস মেন্ডামাস) রেখে আদালত রায়ের আদেশে বলেছে, “সার্বিক আলোচনা-পর্যালোচনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জারি করা রুলটি চূড়ান্ত হওয়ার যোগ্য। অতএব, আদেশ হয় যে, রুলটি বিনা খরচায় চূড়ান্ত করা হল।
“এ রায় ও আদেশের অনুলিপি প্রাপ্তির ৯০ দিনের মধ্যে ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তৎমর্মে হলফনামা সম্পাদন করে অত্র আদালতকে অবহিত করার জন্য সচিব, ভূমি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ প্রদান করা হল।”
২০০৪ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন (সংশোধিত) এর ২ ধারায় ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল এবং ল্যান্ড সার্ভে আপিলের ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলা হয়েছে।
আইন অনুযায়ী দেশে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল গঠনও করা হয়েছে, যে ট্রাইব্যুনালগুলোর নেতৃত্বে আছেন যুগ্ম জেলা জজ পর্যায়ের বিচারিক কর্মকর্তা। কিন্তু আইনে থাকার পরও এখন পর্যন্ত দেশে কোনো ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়নি।
ফলে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের রায়, ডিক্রি এবং আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে হাজার হাজার বিচার প্রার্থীকে আসতে হচ্ছে উচ্চ আদালতে।
২০১৫ সালে এরকম একটি রিট আবেদনের শুনানির সময় উচ্চ আদালত দেখতে পায়, দেশে কোনো ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল নেই। পরে ওই বছরের ৩ মার্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাই কোর্ট বেঞ্চ।
ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের রায়, ডিক্রি ও আদেশে সংক্ষুব্ধ পক্ষগুলোর করা আপিল আবেদন শুনানির জন্য দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য ভূমি সচিব, আইন সচিবকে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় সেই রুলে।
দীর্ঘ শুনানির পর গত বছরের ২৫ জুলাই সংক্ষিপ্ত রায় দেয় আদালত। ১১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
রায়টি লিখেছেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল; বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী তাতে সম্মতি দিয়েছেন।