কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ হত্যার পর টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিরুদ্ধে ‘রেকর্ডসংখ্যক’ মামলা হয়েছে। একের পর এক ভুক্তভোগী তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করছেন। এখন পর্যন্ত কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের আদালতে প্রদীপের বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা করা হয়েছে। অধিকাংশ মামলাই করা হয়েছে বিভিন্ন সময় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত পরিবারের পক্ষ থেকে। স্বজনদের অভিযোগ, টাকার জন্য ওসি প্রদীপ অনেককে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেছেন। অনেক সময় টাকা নিয়েও তার বিরুদ্ধে একইভাবে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি কোনো ওসির বিরুদ্ধে এত মামলা হওয়ার নজির নেই।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সিনহা হত্যার পর ওসি প্রদীপ গ্রেপ্তার হওয়ায় নিহত অনেকের পরিবার মামলা করার সাহস পাচ্ছে। যারা আগে মুখও খুলতেন না, তারাই এখন মামলা করার ভরসা পাচ্ছেন। কারও কারও অভিমত, সময় এখন প্রদীপের প্রতিকূলে থাকায় অনেকেই মামলা করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সর্বশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যার অভিযোগে ওসি প্রদীপসহ ৫৬ জনের বিরুদ্ধে কক্সবাজারের আদালতে দুটি মামলা করা হয়।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, গত ৮ সেপ্টেম্বর আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি আলোচনায় আসে। বৈঠকে আগামীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি মামলার করলে সেটি যাচাই-বাছাই ছাড়া গ্রহণ না করতে পুলিশের পক্ষ থেকে সুপারিশ জানানো হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, প্রদীপ গ্রেপ্তারের পর অনেক ভিকটিম ও তার পরিবার মনে করছে তারা এখন ন্যায়বিচার পাবেন। তাই তারা আদালতে মামলা করছেন। ফৌজদারি অপরাধের কোনো সময়সীমা নেই। যে কোনো সময় মামলা হতে পারে। অভিযোগ দায়েরের ব্যাপারে কাউকে নিরুৎসাহিত করা যাবে না। কোনো ভুক্তভোগী আদালতে গেলে পুলিশের যে কোনো সংস্থা বা অন্য ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে পারেন বিচারক। আবার কেউ থানায় গেলেও পুলিশ অনেক সময় আগে জিডি নেয়। এরপর জিডির সূত্র ধরে তদন্ত করে মামলা করা হয়। কেউ মিথ্যা অভিযোগ করলে শাস্তির বিধানও আইনে রয়েছে। সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে জনগণের অভিযোগ অবশ্যই আমলে নিতে হবে।
জানা গেছে, ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হওয়ার বিষয়টি পুলিশের ভেতরেও কেউ কেউ ভালোভাবে নিচ্ছেন না। তারা বলছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া মামলা করলে বাহিনীর অন্য সদস্যদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
সিনহা হত্যার ঘটনায় তার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে যে হত্যা মামলা করেছেন তাতে দুই নম্বর আসামি প্রদীপ কুমার। ওই মামলায় এরই মধ্যে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মামলার তদন্ত সংস্থা র্যাব। এছাড়া সিনহার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কমিটিও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের চন্দনাইশের দুই ভাই আমানুল হক ফারুক ও আজাদুল হক আজাদকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি ও পরে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার অভিযোগে ওসি প্রদীপসহ ৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন নিহতের ছোট বোন রিনাত সুলতানা শাহীন। চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন নাহার রুমীর আদালতে এ মামলা করা হয়। আদালত মামলাটি গ্রহণ করে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের এএসপিকে (আনোয়ারা) মামলাটি তদন্ত করে ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস্ ফাউন্ডেশন (বিএইচআরএফ) বিনা খরচে বাদীকে আইনি সহায়তা দিচ্ছে।
৮ সেপ্টেম্বর প্রদীপ কুমার দাশসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন কারামুক্ত স্থানীয় সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খান। পরবর্তী ধার্য তারিখের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্নিষ্ট আদালতের বিচারক তামান্না ফারাহ।
টেকনাফে নূর মোহাম্মদ ও মো. আজিজ নামে দুই ব্যক্তিকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যার অভিযোগে ৭ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের আদালতে মামলা করা হয়েছে। এতে ওসি প্রদীপ কুমারসহ ৩১ জনকে আসামি করা হয়। নূর মোহাম্মদের স্ত্রী লায়লা বেগম ও মো. আজিজের মা হালিমা খাতুন বাদী হয়ে মামলা দুটি করেন।
২৭ আগস্ট প্রদীপসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে কক্সবাজারের আদালতে আরেকটি মামলা করা হয়। মামলার বাদী অটোরিকশাচালক আবদুল জলিলের স্ত্রী ছানোয়ারা বেগম। তার অভিযোগ, তার স্বামীকে ধরে নেওয়ার পর ৫ লাখ টাকা আদায় এবং আরও ৫ লাখ টাকা না দেওয়ায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা করা হয়েছে।
সাদ্দাম হোসেন নামে এক যুবকের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনায় ১৮ আগস্ট ওসি প্রদীপসহ ২৮ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগ করা হয়। আদালত অভিযোগটি আমলে নিয়ে ঘটনাটি সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। ওই অভিযোগের বাদী নিহতের মা গুল চেহারা।
‘বন্দুকযুদ্ধে’ মাহামুদুল হক নামে এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে অভিযোগ এনে ওসি প্রদীপ কুমারসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে ২৬ আগস্ট আরেকটি মামলা হয়েছে। কক্সবাজারে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. হেলাল উদ্দিনের আদালতে ওই মামলা হয়। আদালত এজাহারটি পর্যালোচনা করে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের ঘটনায় টেকনাফ থানায় সেই সময়ে দায়ের করা মামলার বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দিয়েছেন। টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজার এলাকার মিয়া হোসেনের ছেলে নুরুল হোছাইন (৪৫) বাদী হয়ে ওই মামলাটি করেন।
৩১ আগস্ট প্রদীপের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় প্রদীপসহ ৪১ জন আসামি। কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম মো. হেলাল উদ্দীনের আদালতে মামলাটি করেন টেকনাফের রঙ্গিখালীর বাসিন্দা সুলতানা রাবিয়া মুন্নী।
টেকনাফকে বলা হয় ‘ইয়াবার স্বর্গ’। এই ইয়াবা ঘিরেই নানা ধরনের অনৈতিক বাণিজ্য চালানোর অভিযোগ রয়েছে প্রদীপের বিরুদ্ধে। শুধু ইয়াবা নয়, মিয়ানমার থেকে গরু পাচার ও কাঠের ব্যবসা ঘিরেও লাখ লাখ টাকা বাণিজ্যের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে আছে। দুই বছর টেকনাফের ওসি থাকাকালে অনেক অঘটনের জন্ম দিয়েছেন প্রদীপ। তার আমলে টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে ১৭৪টি ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটে। টেকনাফে পুলিশ ছাড়া র্যাব ও বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধেও’ প্রায়ই নিহত হন অভিযুক্ত মাদক কারবারিরা।
এদিকে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ তিন কোটি ৯৫ লাখ পাঁচ হাজার টাকা অর্জন ও ১৩ লাখ ১৩ হাজার টাকার তথ্য গোপন করায় প্রদীপ ও তার স্ত্রী চুমকী কারণের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ মামলায় প্রদীপের উপস্থিতিতে সোমবার চট্টগ্রামের আদালতে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।