মানুষের মাঝে সেবা পৌঁছে দেওয়াই যেন মাদার তেরেসার ব্রুত ছিল। সারাজীবন তিনি মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। মানুষের সেবায় যে কত তৃপ্তি পাওয়া যায়, তা মাদার তেরেসার জীবনী পাঠ করলেই বোঝা যায়। মাদার তেরেসা আমাদের সারাজীবন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শক্তি যোগান। কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা মারা যাওয়ার পরও জীবিত থাকেন। মাদার তেরেসা সেরকমই একজন গুণী মানুষ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী শিবিরে মাদার তেরেসা যে সেবা ও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন, তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি সবসময়ই বাংলাদেশের ভালো চেয়েছেন। তাঁর অবদান কখনো ভুলবার নয়। মাদার তেরেসাকে বিশ্বশান্তির পায়রা বলে অভিহিত করা হতো।
মাদার তেরেসার জন্ম ১৯১০ সালেন ২৫ আগস্ট। তিনি একজন আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত ভারতীয়। কিন্তু দেশ বা কালের সীমানা ডিঙিয়ে তিনি ছুটেছেন আর্তের সেবায়। ১৯৫০ সালে কলকাতায় তিনি মিশনারিজ অব চ্যারিটি নামে একটি সেবাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তিনি দরিদ্র, অসুস্থ, অনাথ ও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের সেবা করেছেন। সেই সঙ্গে মিশনারিজ অব চ্যারিটির বিকাশ ও উন্নয়নেও অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। প্রথমে ভারতে ও পরে সমগ্র বিশ্বে তার এই মিশনারি কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৭০-এর দশকের মধ্যেই সমাজসেবী এবং অনাথ ও দুস্থজনের বন্ধু হিসেবে তার খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ম্যালকম ম্যাগাজিনের বই ও প্রামাণ্য তথ্যচিত্র ‘সামথিং বিউটিফুল ফর গড’ তার সেবাকার্যের প্রচারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
১৯৭৯ সালের ১৭ অক্টোবর তিনি তার সেবাকার্যের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার ও ১৯৮০ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ভারতরত্ন লাভ করেন। তিনি বিশ্বের ১২৩টি রাষ্ট্রে এইচআইভি/এইডস, কুষ্ঠ ও যক্ষ্মার চিকিৎসাকেন্দ্র, ভোজনশালা, শিশু ও পরিবার পরামর্শ কেন্দ্র, অনাথ আশ্রম এবং বিদ্যালয়সহ মিশনারিজ অব চ্যারিটির ৬১০টি কেন্দ্র নির্মাণে অবদান রেখেছেন। বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা ও একাধিক রাষ্ট্রের সরকার তার কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে।
তিনি ছিলেন নিকোলো ও দ্রানা বয়াজুর কনিষ্ঠ সন্তান। তাদের আদি নিবাস ছিল আলবেনিয়ায়। ১৯১৯ সালে মাত্র আট বছর বয়সে তার পিতৃবিয়োগ হয়। পিতার মৃত্যুর পর তার মা তাকে রোমান ক্যাথলিক আদর্শে লালন-পালন করেন। জোয়ান গ্র্যাফ ক্লুকাস রচিত জীবনী থেকে জানা যায়, ছোট্ট অ্যাগনেস মিশনারিদের জীবন ও কাজকর্মের গল্প শুনতে খুব ভালোবাসতেন তিনি। ১২ বছর বয়সেই তিনি ধর্মীয় জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে একজন মিশনারি হিসেবে যোগ দেন সিস্টার্স অব লোরেটো সংস্থায়। এরপর তার মা আর দিদিদের সঙ্গে আর তার কোনো দিন দেখা হয়নি। অ্যাগনেস প্রথমে আয়ারল্যান্ডের রথফার্নহ্যামে লোরেটো অ্যাবেতে ইংরেজি ভাষা শিখতে যান। কারণ এই ভাষাই ছিল ভারতে সিস্টার্স অব লোরেটোর শিক্ষার মাধ্যম।
১৯২৯ সালে ভারতে এসে দার্জিলিংয়ে নবদীক্ষিত হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং ১৯৩১ সালের ২৪ মে তিনি সন্ন্যাসিনী হিসেবে প্রথম শপথ গ্রহণ করেন। স্কুলে পড়াতে তার ভালো লাগলেও কলকাতার দারিদ্র্যে তিনি উত্তরোত্তর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে লাগলেন। ১৯৪৮ সালে এই মোতাবেক দরিদ্রদের মাঝে মিশনারি কাজ শুরু করেন। প্রথাগত লোরেটো অভ্যাস ত্যাগ করেন। পোশাক হিসেবে পরিধান করেন নীল পারের একটি সাধারণ সাদা সুতির বস্ত্র। এ সময়ই ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বস্তি এলাকায় কাজ শুরু করেন। তার কার্যক্রম অচিরেই ভারতীয় কর্মকর্তাদের নজরে আসে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তার কাজের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তার মিশনারি কলকাতায় মাত্র ১৩ জন সদস্যের ছোট্ট অর্ডার হিসেবে চ্যারিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। অচিরেই মিশনারিস অব চ্যারিটি দেশ-বিদেশের বহু দাতা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়। ১৯৯৭ সালের ১৩ মার্চ মিশনারিস অব চ্যারিটির প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। ৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন বিশ্ব শান্তির অন্যতম পুরোধা মাদার তেরেসা।