নানা বিতর্কের পর সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাদ দেওয়ার আভাস পাওয়া গেলেও শেষ পর্যন্ত তা হচ্ছে না। আসন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাতিল করার কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। আগামী ডিসেম্বরে প্রথম ধাপে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়ার কথা রয়েছে। সেই অনুযায়ী দলীয় প্রতীক বাতিল করা হলে এখনই দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ বা নির্বাচন কমিশন কিছুই জানে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্তরাও দলীয় প্রতীক বাতিলের বিষয়টি উড়িয়ে দেন। এ পরিস্থিতিতে আসন্ন নির্বাচনও দলীয় প্রতীকেই অনুষ্ঠিত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হেলালুদ্দীন আহমদ গতকাল রবিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাতিলের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আগামী বছরের শুরুতে নির্বাচন হওয়ার কথা। সেখানে সরকারের এমন উদ্যোগ থাকলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অবশ্যই অবহিত থাকত। আমার জানামতে দলীয় প্রতীকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নির্বাচন নিয়ে নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে।’
স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন উন্মুক্তভাবে হওয়ার বিধান বাতিল করে বর্তমান সরকার দলীয় প্রতীকে তা সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনসংক্রান্ত আইনে সংশোধনী আনা হয়। সেই সময় দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রথম ধাপ সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার নির্বাচন দিয়ে শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও দলীয় প্রতীক ব্যবহার করা হয়।
দলীয় প্রতীকের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব (ইউনিয়ন পরিষদ) মো. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে। এ লক্ষ্যে সরকার সব ধরনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। দলীয় প্রতীক প্রত্যাহার করার মতো কোনো সিদ্ধান্ত থাকলে সেখানে আমাদের দাপ্তরিক কার্যক্রম করতে হবে। এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আর নির্বাচনের যে সময় সামনে আছে এতে মনে হয় না এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। ফেইসবুকে জনপ্রতিনিধিদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দলীয় প্রতীক বাতিল নিয়ে নানা গুজব চালিয়ে যাচ্ছে একটি মহল। এসব তথ্যের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই।’
আওয়ামী লীগ সভাপতিমন্ডলীর ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য আব্দুর রহমান গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলীয় প্রতীকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দলীয় প্রতীক বাতিল করার কোনো সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ থেকে নেওয়া হয়নি।’
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক নিয়ে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হচ্ছে কি না এটা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বিষয়। এটা নির্বাচন কমিশনের কিছু না। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২ (আরপিও)-এ পরিবর্তন এনে সংশোধনী আইন ইতিমধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখানে আরপিওর পরিবর্তনের সঙ্গে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই।’
তবে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে নানা মত রয়েছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দলীয় প্রতীকে নির্বাচন স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়েছে। এর ফলে তৃণমূল পর্যন্ত মনোনয়ন বাণিজ্য পৌঁছে গেছে। দলের হাইকমান্ড তাদের পছন্দের লোকজনকে মনোনয়ন দিচ্ছে। মনোনয়ন পাওয়ার পরই তারা নিজেদের নির্বাচিত ভাবতে থাকেন। এ ধরনের ব্যবস্থার কারণে জনপ্রিয় মানুষ প্রার্থী হতে পারেন না। দলীয়ভাবে মনোনয়ন দিয়ে অনাকাক্সিক্ষত ব্যক্তিদের নির্বাচিত করা হচ্ছে। এই দুর্যোগে জনপ্রতিনিধিদের এড়িয়ে গিয়ে সব কার্যক্রম করা হয়েছে। কারণ তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি সরকার। সর্বোপরি বলব, দলীয় প্রতীকে এ নির্বাচনের ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।’
অবশ্য দলীয় প্রতীকে এ নির্বাচন হলেও কোনো ক্ষতি নেই বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তবে তা কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে হতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দলীয় প্রতীকে এ নির্বাচন হলেও কোনো ক্ষতি নেই। তবে তা হতে হবে ভিন্নভাবে। ইউপি সদস্যরা দলীয় মনোনয়ন পাবেন। সেখান থেকে নির্বাচিত ৯ সদস্যের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীর প্রায় সব গণতান্ত্রিক দেশে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকেই হয়। কিন্তু সেখানে সরাসরি চেয়ারম্যান নির্বাচনের সুযোগ নেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলীয় প্রতীক বাতিল করলেও গুণগত কোনো পরিবর্তন আসবে না। দলের আশীর্বাদ যার ওপর থাকবে সেই নির্বাচিত হবেন। তাই নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হলেও পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।’