বলা হচ্ছে, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের চূড়ান্ত বিপজ্জনক সময় পার করছে বাংলাদেশ। যদিও গত ৩১ মে থেকে ‘সীমিত পরিসরে’ সবকিছু খুলে দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ের এই সময়ে এখন আর কোনো কিছুই ‘সীমিত পরিসরে’ নেই। রাস্তায় যানবাহনের ভিড়ে তীব্র যানজট হচ্ছে। ফুটপাতেও দূরত্ব বজায় রেখে হেঁটে চলাফেরার সুযোগ নেই। না চাইলেও বহু মানুষের সঙ্গে ধাক্কা খেতে হয়। এমনকি বাজারগুলোতেও মানা হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব। মানুষকে সচেতন করতে এখন আর খুব বেশি প্রচারণাও চোখে পড়ছে না। মার্কেটগুলোর ভেতরে বা ট্রাফিক সিগন্যালের কিছু কিছু জায়গায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য রেকর্ড করা অডিও বাজানো হচ্ছে। কাঁচা বাজার বা মাছের বাজার এমন সব জায়গায় প্রচারণা চোখে পড়ছে না।
গতকাল রবিবার সপ্তাহের প্রথম দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ‘প্রায়’ আগের রূপেই ফিরেছে রাজধানী। গতকাল বেলা ১১টার দিকে ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজার পার হতেই গাড়িতে আধা ঘণ্টা লেগে যায়। তীব্র যানজটে অনেককেই গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাত দিয়ে পায়ে হেঁটে যেতেও দেখা গেল। কারওয়ান বাজারের একটি ব্যাংকে জরুরি সেবা নিতে আসা ব্যবসায়ী আমিনুল হাকিম বলেন, ‘আমি শত চেষ্টা করেও ফুটপাত দিয়ে ধাক্কা না খেয়ে আসতে পারিনি। আমি নিজে সাবধান থাকার চেষ্টা করে কী করব? আমার আশপাশের লোকজন যদি সচেতন না হন তাহলে কেউ একা সাবধান থেকে কিছুই করতে পারবে না। ব্যাংকের বাইরেও লাইনে দাঁড়িয়ে ধাক্কা খেতে হচ্ছে।
বসুন্ধরা সিটির সামনে দুপুর ১২টার দিকে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখন যে অবস্থা তাতে রাস্তায় বের হলে সৃষ্টিকর্তা আর নিজের ভাগ্যের ওপর ভরসা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমি নিজে যতই সচেতন থাকি না কেন, সবাই সচেতন না হলে কিচ্ছু হবে না। এখন রাস্তায় যত মানুষের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছি, তার মধ্যে কোনো এক জন যদি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন তাহলে নিশ্চিত আমিও আক্রান্ত হব। যত চেষ্টাই করি না কেন, দূরত্ব বজায় রেখে কিছুতেই চলা যাচ্ছে না। এত মানুষ মারা যাচ্ছে, তবুও কেন যেন আমাদের হুঁশ ফিরছে না।’
একই জায়গায় কথা হয় এক জন ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে। নিজের নাম গোপন রেখে শুধু পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, ‘চারদিকে তাকিয়ে দেখেন ফুটপাতে সব দোকান বসে গেছে। আপনি হাঁটবেন কোন জায়গা দিয়ে। হ্যাঁ, এখন সংকটে সবাই। ফুটপাতের ওদের আমি তুলে দিতে বলছি না, কিন্তু মানুষের নিরাপদে চলাচলের জায়গাটাতো দরকার।’
দুপুর ১টার দিকে বাংলামটরে আলাপ হয় বাসযাত্রী খালেক মোল্লার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মিরপুর থেকে বাসে করে বাংলামটরে এসেছি। শুরুতে খুব বেশি যাত্রী না থাকলেও ফার্মগেটে আসার পর আমার পাশের সিটেই আরেকজন বসে পড়েন। প্রতিবাদ জানালে ঐ যাত্রী উত্তেজিত হয়ে উঠেন। সুপারভাইজারও তার পক্ষ নেন। অন্য অনেক যাত্রীই বলেন, সবাইকেই তো যেতে হবে, কী আর করা? বিকল্প কোনো উপায় না থাকায় বাধ্য হয়েই আমাকে আরেক জনের পাশে বসে আসতে হয়েছে।’
ফার্মগেটের ওভারব্রিজের নিচে স্বল্পমূল্যের ইলেকট্রিক সামগ্রী বিক্রেতা আব্দুল মাজেদ বলেন, ‘কী করব ভাই? পেট তো চলে না? যা হওয়ার তাই হবে। তবে গরীব মানুষের করোনা ধরে না। অনেকদিন ঘরে বসে ছিলাম, এখন আর বসে থাকা সম্ভব না। কেউ যদি এখন দোকান তুলে দেয় তাহলে ভিক্ষা করা ছাড়া কোনো পথ নেই।’ মাজেদের মতো একই ধরনের কথা বললেন ঐখানে ফুটপাতে দোকান করা আরো কয়েক জন।
বিজয় স্মরণী সিগন্যালে দেখা গেল রেকর্ড করা সচেতনতামূলক অডিও বাজছে। বসুন্ধরা সিটির মধ্যেও অডিওতে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, মৃত্যু ঝুঁকির কথা বলে সচেতন থাকার কথা বলা হচ্ছে। অভিজাত শপিং মল বা ট্রাফিক সিগন্যালে এমন অডিও বাজলেও রাজধানীর বাজারগুলোতে এমন কিছুই চোখে পড়ছে না। অনেকের মধ্যেই গা ছাড়া ভাব দেখা গেছে। কেউ কেউ কঠোরভাবে মেনে চলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন।
শেওড়াপাড়া বাজারে মাছ কিনতে আসা গৃহবধূ আসমা খাতুন বলেন, দুটো দোকানের মধ্যে এতটুকু জায়গা যে, এক জন দাঁড়িয়ে থাকলে পাশ দিয়ে অন্য কেউ যেতে পারবে না। আর যদি যায় তাহলে তার সঙ্গে ধাক্কা লাগবেই। সবকিছু জেনে বুঝেই বাজারে আসতে হচ্ছে। অনেকেই তো বলছেন, বাজার থেকেই অধিকাংশ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। এখন শাকসবজি বাসার সামনে ভ্যান থেকে কেনা যাচ্ছে। কিন্তু বাসার সামনে মাছ পাওয়া যায় না। ফলে বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ কিনতে বাজারে এসেছি।’ এমন চিত্র রাজধানীর সবগুলো কাঁচাবাজারে।