আশরাফ-উল-আলম
করোনার প্রাদুর্ভাবে বেশির ভাগ অফিস-আদালতই বন্ধ। সরকারি অফিস ছুটির ঘোষণার পরপরই আসছে আদালতের ছুটি ঘোষণা। কিন্তু সেই প্রথম থেকেই বিচারকরা আদালতে মামলা পরিচালনা করছেন। অনেকে জানে না। আবার জানলেও এই বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে কারো সাড়াশব্দ নেই। সারা দেশের বিচারকরা গত মার্চ থেকেই এ দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্প্রতি ভার্চুয়াল আদালত গঠন করে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন আদালতের বিচারকদের। নতুন এই পদ্ধতির দায়িত্ব পালন করছেন বিচারকরা। কিন্তু এর বাইরেও বিচারকরা নিয়মিত দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের মহানগর হাকিম শাহিনুর রহমান গত সোমবার (১৮ মে) দুটি হত্যা মামলার দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করেন। এক আসামির নাম শফিকুর রহমান। তিনি ঠিকাদার বাশার হত্যা মামলার আসামি। আরেক আসামি উজ্জ্বল। তিনি তাঁর পরিচিত একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছেন বলে স্বীকারোক্তি দেন। খাসকামরায় এই আসামিদের জবানবন্দি নেওয়া হয়।
খাসকামরায় আটক পুলিশ কর্তৃক আটক কোনো ব্যক্তির জবানবন্দি গ্রহণ করা, আসামিদের সঙ্গে কথা বলা, আসামির সঙ্গে থাকা পুলিশের সঙ্গে কথা বলা, মামলার নথি পর্যালোচনা করা, আবার আদালতে ওই সব আসামির বিভিন্ন আবেদনের ওপর শুনানি গ্রহণ করেই চলেছেন বিচারকরা।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ২৫ মার্চ সর্বশেষ অফিস-আদালত খোলা ছিল। এর পর থেকে ছুটি চলছে। আদালতের নিয়মিত বেঞ্চ সেদিন থেকেই বন্ধ রয়েছে। কিন্তু বিশেষ আদালত ওই দিন থেকেই শুরু হয়েছে। দেশে প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধিতে কোনো আসামি গ্রেপ্তারের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতে হাজির করার বিধান রয়েছে। এই করোনাকালেও আসামি গ্রেপ্তার থেমে নেই। প্রতিদিনই কোনো না কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। নেওয়া হচ্ছে আদালতে। আর ওই সব আসামির রিমান্ড, জামিন ও অন্যান্য বিষয়ে শুনানিও গ্রহণ করতে হয়। তাদের শুনানি গ্রহণ করার জন্য নিয়মিত কোনো না কোনো আদালতকে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।
আসামি আদালতে আনা-নেওয়া, আদালতে হাজির করার পর শুনানি গ্রহণ, জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার এসব দায়িত্ব পালন করছেন বিচারকরা। খবর নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত গতকাল পর্যন্ত ৫০ জন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করেছেন গত দুই মাসে। ভিকটিমের জবানবন্দি গ্রহণ করেছেন ৪০ জনের। ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় সাতজন আসামি জবানবন্দি দেন। ১৫ জন ভিকটিমও জবানবন্দি দেন এ সময়ের মধ্যে। চট্টগ্রামের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে গত দুই মাসে ৩৫ জনের বেশি নারী শিশু ভিকটিম জবানবন্দি দেন। আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন ৪০ জনেরও বেশি। চট্টগ্রামের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে ২৪ জন আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ১০ জনেরও বেশি ভিকটিমও জবানবন্দি দেন এই আদালতে।
জানা গেছে, এই দায়িত্ব পালনের জন্য অতিরিক্ত কোনো ভাতা নেই বিচারকদের। নেই কোনো ঝুঁকি ভাতাও। এর পরও সরকারি দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁরা পালন করে থাকেন। বিচারকরা কেউ ছুটিতে নেই। কর্মস্থলে উপস্থিত আছেন সবাই। যখন যাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে তখনই তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি ভার্চুয়াল আদালত গঠন করা হয়েছে জেলায় জেলায়। ওই সব আদালতেও পৃথকভাবে বিচারক নিয়োগে দেওয়া হয়েছে। এই বিচারকরা সংশ্লিষ্ট ওই আদালতেরই বিচারক। এখন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। যেতে হচ্ছে আদালতে। আদালতের কর্মচারী, কর্মকর্তা, পুলিশ, আসামি সবার সংস্পর্শে আসতে হচ্ছে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু ঝুঁকি তো থাকছেই।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় অবশ্য নিয়মিত খোঁজখবর রাখছে বিচারকদের। আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বিচারকদের সার্বিক বিষয় তত্ত্বাবধান করার জন্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। মন্ত্রীর দেওয়া নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেন আইনসচিব মো. গোলাম সারওয়ার। করোনাভাইরাসের কারণে গত ২৬ মার্চ থেকে ছুটি ঘোষণার পর পরই আইনমন্ত্রী বিচারকদের ও বিচারসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এবং বিচারকাজে জড়িত সবার খোঁজখবর, সুবিধা-অসুবিধা দেখার জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করার নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আইনসচিব আইন মন্ত্রণালয়ের দুজন কর্মকর্তাকে মনিটরিং সেলের দায়িত্ব দেন। দুই কর্মকর্তা হলেন আইন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শেখ গোলাম মাহবুব ও এস মোহাম্মদ আলী।
তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মামলা পরিচালনার অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে কয়েক দিন আগে। ওই অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করতেই আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন। এ ছাড়া বিচারকরা এক দিনের সমপরিমাণ বেতন প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করেছেন।
আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনা মহামারির মধ্যে দায়িত্ব পালন করছেন যাঁরা, তাঁরা তো যোদ্ধা। সূত্রঃ কালের কন্ঠ।
এপিএস/২২মে/পিটিআই