দেশে করোনা ভাইরাসের অতি সংক্রামক নতুন ভ্যারিয়েন্ট ডেলটার (ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট) কমিউনিটি ট্রান্সমিশন দ্রুত বাড়ছে। সীমান্তবর্তী জেলাসহ অর্ধশতাধিক জেলায় সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী। আর ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সক্ষমতা নেই। অনেক জেলায় আইসিইউ নেই। ডাক্তার-নার্স সংকটও প্রকট। তাই সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে রোগীরা রাজধানীতে আসছে। এ কারণে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ঢাকায়ও বেড়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও বলছে, প্রতিদিনই করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানীতে করোনায় আক্রান্তদের ৬৮ ভাগই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। তারপরও কোথাও স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। সর্বত্রই স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে এবং ব্যাপক হারে টিকাদান কার্যক্রম চালাতে হবে। যেহেতু টিকার সংকট চলছে তাই কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যবিধি পালনে গাফিলতি করলে সামনে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মানাতে হবে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে কঠোর থেকে কঠোরতর হওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
গত এক দিনে ঢাকা মহানগরীসহ জেলায় ১ হাজার ১৩৫ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা সারা দেশে সর্বোচ্চ। এছাড়া রাজশাহীতে ৩৩৪ জন, দিনাজপুরে ২৭৫ জন, যশোরে ২০৩ জন, খুলনায় ১৮১ জন এবং চট্টগ্রাম জেলায় ১৬৯ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে গত ২৪ ঘণ্টায়। বিভাগওয়ারি হিসেবে ঢাকা বিভাগে গত এক দিনে ১ হাজার ৩২৮ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে, যা সারা দেশে মোট শনাক্তের ৩৫ শতাংশ। আগের দিন ঢাকা বিভাগে শনাক্ত হয়েছিল মোট ১ হাজার ৫৭৯ জন । রাজশাহীতে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৭১২ জন থেকে বেড়ে ৮১৩ জন হয়েছে। খুলনা বিভাগে গত এক দিনে শনাক্ত হয়েছে ৮১৮ জন নতুন রোগী, যা আগের দিন ৮০০ জন ছিল। দেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ বাড়লেও কেউই লকডাউন মানেন না, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন না। স্বাস্থ্যবিধি মানতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণেই রাজধানীসহ সারা দেশে সংক্রমণ বাড়ছে। উত্তরাঞ্চলের মধ্যে শুধু রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়ায় আইসিইউ আছে। কিন্তু সেখানেও জনবল সংকট। রাজশাহী জেলাতে যে পরিমাণ করোনা রোগী, তাদের চিকিৎসাসেবা দিতেই হিমশিম খেতে হয় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের। তাহলে প্রতিষ্ঠানটি পুরো বিভাগের করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেবে কীভাবে?
করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও গত দেড় বছর ধরে বিশ্ব জুড়ে ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে যাওয়া করোনা ভাইরাস রূপ বদলাচ্ছে ক্রমাগত। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে এর বেশ কয়েকটি ‘মিউট্যান্ট’ বা পরিবর্তিত ধরন পাওয়া গেছে, যেগুলো অনেক বেশি সংক্রামক। এর মধ্যে ভারতে গত বছরের শেষ দিকে একটি নতুন ধরন শনাক্ত হয়, যাকে এ বছর দেশটিতে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে রেকর্ড সংক্রমণ ও মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করা ভাইরাসের এ ধরনটির আনুষ্ঠানিক নাম বি.১.৬১৭। তবে আলোচনার সুবিধার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে বলছে ‘ডেলটা’। তবে সম্প্রতি ভারতে এর চেয়ে বেশি শক্তিশালী ধরন দেখা দিয়েছে। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডেলটা প্লাস’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ভারতে নতুন করে করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ডেলটা প্লাস দেখা দিয়েছে। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকায় সংক্রমণ বাড়ছে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব কিছু করতে হবে। আর স্বাস্থ্যবিধি পালনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। এখন সকলের দায়িত্ব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, ঢাকায় রোগী বাড়ছে। করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে দুইটি পথ হলো, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে আর টিকা দিতে হবে। বর্তমানে যে অবস্থা তাতে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মানাতেই হবে। নইলে সামনে ভয়াবহ অবস্থা হবে।
করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ বাড়ছে। তারপরও সীমান্তবর্তী জেলায় লকডাউন কার্যকর হয় না। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানে না। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তিনি বলেন, সীমান্তবর্তী যে এলাকায় করোনা রোগী বাড়ছে, সেই এলাকায় রোগীর চিকিত্সা দেওয়ার সক্ষমতা নেই। সবাই ঢাকায় আসছে। এ কারণে ঢাকায় সংক্রমণ বেশি। কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনা নিয়ন্ত্রণে আনার পরামর্শ দেন তিনি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, প্রতিদিনই করোনা রোগী বাড়ছে। গত ১০ দিন ধরে হাসপাতালে করোনা রোগী বাড়ছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিট ও ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালেও প্রতিদিন করোনা রোগী বাড়ছে।