দেশে সংক্রামক রোগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্র মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। কিন্তু হাসপাতালটি নিজেই যেন নানা রোগে সংক্রমিত। চারদিকে ডাস্টবিন, মাঝখানে হাসপাতাল। এই হাসপাতালের ভেতর ও চারপাশ ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। সামান্য বৃষ্টিতেই হাসপাতালে প্রবেশের রাস্তায় হাঁটুপানি জমে যায়। হাসপাতালের চারপাশ ঘিরে চলে মাদক ব্যবসা। যেন অপরাধীদের অভয়ারণ্য।
সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো, হাসপাতালের ৩৫ একর জায়গার মধ্যে ২৫ একরই বেদখল হয়ে আছে। এসব জায়গায় অবৈধভাবে ঘর উঠানো হয়েছে। অবৈধ গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ সবই আছে। এসব অবৈধ সংযোগের বিল পান তিতাস ও বিদ্যুতের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী। কিছু অবৈধ ঘরের মালিক খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ কারণে গত ৪৯ বছরে বহুবার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের আদেশ এলেও তা বাস্তবায়ন হয় না। সরকার বদল হয়ে দখলদার বদল হয়, কিন্তু হাসপাতাল দখলমুক্ত হয় না। বেদখল হওয়া ২৫ একর জায়গা থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। এই টাকার ভাগ পান স্থানীয় রাজনৈতিক দলের একশ্রেণির নেতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণির সদস্য এবং মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী।
১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০০ শয্যার হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর আর সম্প্রসারণ করা হয়নি। আধুনিকতার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া সেখানে লাগেনি। দেশের চিকিত্সা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হলেও গুরুত্বপূর্ণ এই হাসপাতালের দিকে কারো যেন নজর নেই। অথচ এই হাসপাতালের পাশেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বসেন।
মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে ১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা গেছে, মূলফটকের আশপাশে নোংরা, ভেতরের পরিবেশও স্যাঁতসেঁতে। ভবনের দেওয়াল চুইয়ে বৃষ্টির পানি মেঝেতে পড়ছে। সাততলা হাসপাতাল ভবনের অভ্যন্তর কিংবা আশপাশের চরম অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশ দেখলে যে কেউ চমকে উঠবেন। হাসপাতালের এই নোংরা পরিবেশই নানা সংক্রামক ব্যাধির উৎসস্থল। চিকিৎসা সেবা প্রদানের ন্যূনতম পরিবেশ নেই। পানি নিষ্কাশনের জন্য নেই ড্রেনেজ ব্যবস্থা। ফলে একটু বৃষ্টি হলেই হাসপাতালের সামনে পানির সঙ্গে ময়লা-আবর্জনা মিশে একাকার হয়ে যায়। হাসপাতালের ২৫-একর জায়গার ওপর যে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে, সেখানে প্রায়ই আগুন লাগে। কিছু গোষ্ঠী আগুন লাগিয়ে দেয় দখল নেওয়ার জন্য। এতে যারা ভাড়া দিয়ে সেখানে থাকেন, সেসব সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে যান।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে আগতদের মধ্যে কুকুর, বিড়াল ও শিয়ালের কামড় খাওয়া রোগী বেশি। এছাড়া জন্ডিস, ধনুষ্টংকার, জলবসন্ত, ডিপথেরিয়া, এনফেলোকাইটিস, ভাইরাল হেপাটাইটিস, এআরভি ভ্যাকসিনের প্রতিক্রিয়া ঘটা রোগীরাও এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। এইচআইভির (এইডস) মতো মারাত্মক রোগীসহ নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, হাম, মামস-জাতীয় রোগের চিকিত্সাও দেওয়া হয় এখানে। রোগ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ও গবেষণা হয় সেখানে। তবে হাসপাতালে কোনো আইসিইউ নেই। তবে পাঁচ বেডের আইসিইউ চালুর প্রক্রিয়া চলছে। কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা নেই। কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য এ হাসপাতালে ৫০ বেড রাখা হয়েছে। কিন্তু অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে গত সপ্তাহ থেকে এসব শয্যা খালি পড়ে আছে।
হাসপাতালের কয়েক জন কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা সেখানকার মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকেন। এ কারণে সেখানে নিরাপদে মাদক ব্যবসা চলে। এ রকম পরিস্থিতিতে হাসপাতালে আগত রোগী ও তাদের আত্মীয়স্বজন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সন্ধ্যার পর হাসপাতালে যাতায়াত করার সময় অনেকে ছিনতাইয়ের শিকার হন।
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, হাসপাতালটির এই দুরবস্থা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। সংস্কার ও সম্প্রসারণের জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছি। দ্রুত সম্প্রসারণ ও আধুনিক করা উচিত। তিনি জানান, প্রতিদিন এই হাসপাতালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৫০০-৬০০ রোগী আসেন। তাদের বিনামূল্যে বিভিন্ন ভ্যাকসিন দেওয়া হয়।
হাসপাতালের পাশেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সেখানকার পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার জন্য সিটি করপোরেশনকে বার বার বলা হলেও তারা উদ্যোগ নেয় না। হাসপাতালের জমি দখলমুক্ত করার বিষয়ে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে ওপরের নির্দেশ না এলে আমাদের কিছুই করার নেই। ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল স্থাপনের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভাবা হচ্ছে বলে তিনি জানান।