রাশিয়ার স্পুটনিক ও চীনের সিনোফার্মের করোনা ভাইরাসের টিকা বাংলাদেশেই উত্পাদন করা হবে। এ ব্যাপারে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দিয়েছে। গতকাল বুধবার মন্ত্রিসভা কমিটির এই বৈঠকে দেশি কোনো কোম্পানিকে বিদেশি টিকা উত্পাদনের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে দেশি কোন কোম্পানি এই টিকা বানাবে, সেটি এখনো ঠিক হয়নি। একাধিক ওষুধ কোম্পানি এই টিকা তৈরি করার জন্য যোগাযোগ রাখছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, রাশিয়া ও চীনের করোনা ভাইরাসের টিকা দেশে দ্রুত উত্পাদনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ দুই দেশের টিকা ভালো। রাশিয়ার টিকা ৬০টি দেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে। কারো কোনো সমস্যা হচ্ছে না। মানুষ উপকৃত হচ্ছে। তিনি বলেন, রাশিয়া ও চীনের টিকা এখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন না পেলেও দ্রুত পেয়ে যাবে। আগামী সপ্তাহে চীনা টিকা অনুমোদন পেয়ে যেতে পারে। রাশিয়ার টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পাওয়ার কার্যক্রম চলছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, রাশিয়ার টিকা ভালো, অনেক দেশ নিচ্ছে। চীনের টিকাও ভালো। এ দুই দেশের টিকা দেশে উত্পাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এটা খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেশে উত্পাদনের জন্য প্রযুক্তি ও কাঁচামাল আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, রাশিয়ার করোনা ভাইরাসের টিকা ভালো। ৬০টি দেশে এটি দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের জন্য তারা আবেদন করেছে। চীনের টিকাও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেয়ে যাবে। এ দুই দেশের টিকা ভালো। তিনি বলেন, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট টিকা রপ্তানি করেছে, কারণ টিকা উত্পাদনের কাঁচামাল আমেরিকা বন্ধ করে দিয়েছে। সিরাম ইনস্টিটিউটেও টিকা উত্পাদন বন্ধ হয়ে যায়। তবে এখন আবার কাঁচামাল দিচ্ছে আমেরিকা। রাশিয়া ও চীনের টিকা দেশে উত্পাদনের উদ্যোগ খুবই ভালো। তবে সিরাম ইনস্টিটিউটের মতো অবস্থা যাতে না হয়, সে জন্য টিকা উত্পাদনের প্রযুক্তি ও কাঁচামাল যেন সংশ্লিষ্ট দেশ দুটি দেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি বলেন, ভারতেও রাশিয়ার টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে। ইরানেও তৈরি হচ্ছে রাশিয়ার করোনার টিকা।
আইইডিসিআরের প্রধান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, রাশিয়া ও চীনের করোনা ভাইরাসের টিকা দেশে উত্পাদনের উদ্যোগ খুবই ভালো। এভাবে টিকা উত্পাদন করে দেশের মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে। তাহলে আর আইসিইউর প্রয়োজন হবে না। মৃত্যুর হার অনেক কমে যাবে। তবে টিকার মূল্য যেন জনগণের সাশ্রয়ে থাকে।
মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে অন্য উত্স থেকে টিকা আনার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রস্তাব ছিল, বিকল্প সোর্স থেকেও আমরা ভ্যাকসিন কিনব বা সংগ্রহ করব। এর মানে এই নয় যে, বর্তমান যে সোর্স রয়েছে, সেটি বাতিল হয়ে গেছে। ভারত থেকে যে টিকা আনা হচ্ছে, সেটি অ্যাকটিভ আছে। প্রথম সোর্সটি আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। এখন বিকল্প হিসেবে রাশিয়ান স্পুিনক এবং চীনের সিনোফার্ম বা সিনোভ্যাকে ভ্যাকসিন সংগ্রহের বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ দুটি দেশ বা এ দুটি ভ্যাকসিন সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।’
করোনা ভাইরাসের টিকা উদ্ভাবনের পর থেকে বাংলাদেশে টিকা উত্পাদনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। অনেক কোম্পানি তাদের সক্ষমতার কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশে এই টিকা উত্পাদনের কোনো সুযোগ আছে কি না, জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেছিলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা চলছে। বাংলাদেশে পপুলার, ইনসেপ্টা ও হেলথকেয়ার টিকা তৈরি করতে পারে। ইনসেপ্টা রাশিয়ার সঙ্গে এরই মধ্যে কথাবার্তা শুরু করেছে। তারা বলেছে, আমাদের দেশে টিকা তৈরি করা যায় কি না। টেকনোলজি ট্রান্সফারও হতে পারে, আবার বাল্ক এনে ফিলার ফিনিশও হতে পারে। কিনে এনেও হতে পারে। ইনশাআল্লাহ, আমাদের দেশেই এই ভ্যাকসিন তৈরি হবে।’ বুধবারের বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শাহিদা আক্তার বলেন, ‘রাশিয়ার স্পুিনক ও চীনের সাইনোফার্মের টিকা বাংলাদেশে তৈরির নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশি কোন কোম্পানি এই টিকা বানাবে, সেটি আলোচনায় উঠে আসেনি। তবে দেশি কোম্পানিগুলোর সেই সক্ষমতা আছে, এটা আলোচনা হয়েছে। এক্ষেত্রে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির নাম আলোচনায় উঠেছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ভ্যাকসিন উত্পাদনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কোনো বিশেষ কোম্পানির নাম আলোচনায় আসেনি। বলা হয়েছে, যারা সক্ষম কেবল তাদের দিয়ে উত্পাদন করানো হবে। এ বিষয়ে কারিগরি কমিটি বিস্তারিত আলোচনা করেছে। অতি দ্রুততার সঙ্গে এটা বাস্তবায়ন করা হবে।
বৈঠকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোরস ডিপোর (সিএমএসডি) মাধ্যমে আরটি-পিসিআর টেস্ট কিট এবং পিসিআর ল্যাব কনজ্যুমেবলস বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কেনার নীতিগত অনুমোদনও দেওয়া হয়। একই প্রতিষ্ঠানের জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী ও চিকিত্সা সরঞ্জাম কেনারও নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিগত দিনগুলোতে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে মাস্ক কেলেঙ্কারিসহ অন্যান্য নিম্নমানের সামগ্রী কেনার বিষয়টি উল্লেখ করে আবারও কেন একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে, তা জানতে চান একজন সাংবাদিক। উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা নিয়ম-নীতি অনুসরণ করেই অনুমোদন দিই। কেনাকাটার সময় যদি কোনো ব্যত্যয় থাকে, মিসম্যাচ থাকে, তারা যদি কোয়ালিটি এনসিওর করতে না পারে, সেটা তাদের ব্যাপার।’
ভারত সরকারের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (এসআইআই) চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে করোনা ভাইরাসের ৩ কোটি ডোজ টিকা বাংলাদেশে সরবরাহ করতে পারবে না বলেই মনে করছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। বাংলাদেশে সিরাম ইনস্টিটিউটের টিকার ‘এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর’ বেক্সিমকো ফার্মা গতকাল বুধবার লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জকে জানিয়েছে, ভারত সরকার রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করলে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের টিকার চালান পাওয়ার নতুন সূচি নির্ধারণ করা হবে।
সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি ডোজ করোনা ভাইরাসের টিকা কিনতে গত বছরের নভেম্বরে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে বাংলাদেশ। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে ছয় মাসে ৩ কোটি ডোজ টিকা পাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের। বেক্সিমকো ফার্মা বাংলাদেশের ঐ টিকা সংরক্ষণ এবং সারা দেশে সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে এবং সেজন্য তারা আলাদা ‘ফি’ পাবে বলে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জকে জানিয়েছে।