করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসকের মৃত্যুর সংখ্যা আবারও বাড়ছে। কেবল চলতি এপ্রিল মাসেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৭ জন চিকিৎসক, যা সর্বমহলে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ডাক্তাররা সবার প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ‘কেউ নিজে রোগী হবেন না, আমাদের মারবেন না। আপনারা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে রোগী হয়ে আসবেন আর আমরা চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে মারা যাব—এটা আর কত দিন? বর্তমানে দেশে ৭ হাজার করোনা রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। এর চেয়ে দ্বিগুণ কিংবা তিন গুণ রোগী হলে তাদের সেবা দেব কীভাবে? তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, নিজে বাঁচুন, দেশ ও সমাজকে বাঁচান।’
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রমণ রোগ বিভাগের প্রধান ডা. ফাহিম ইউনুস ২০ বছর ধরে সেখানে ভাইরাস নিয়ে কাজ করছেন। সম্প্রতি এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ কত মাস বা কত বছর থাকবে তা কেউ জানে না। এই অজানা সময়কে অস্বীকার করার যেমন দরকার নেই, তেমনি আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। কোভিড ভাইরাস পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা যা বোঝতে পেরেছেন তা হলো, জীবনকে অহেতুক কঠিন করার প্রয়োজন নেই। আমাদের সুখে থাকা কিংবা নিরাপদে থাকার জন্য শুধু তিনটি কাজ করতে হবে। তা হলো—মাস্ক পরা, হাত ধোয়া এবং ১ দশমিক ৮ মিটার দূরত্ব বজায় রাখা। এই তিনটি কাজই হলো ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার সেরা পদ্ধতি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সহজেই এই মরণব্যাধি থেকে নিজে বাঁচুন, অন্যকে বাঁচান।’
দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিম্নমুখী হয়। তবে মার্চের শুরু থেকে আবার ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়। এটাকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বলছেন অনেকে। তবে চিকিৎসকেরা একে অভিহিত করছেন ‘করোনার সুনামি’ নামে। তারা বলছেন, গত বছরের চেয়ে এবারের সংক্রমণ তীব্র। আর এই সুনামিতে চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। গত বছর করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হতে শুরু করেন। তবে সেটা কিছুটা কমে আসে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ২৯৬ জন স্বাস্থ্যকর্মী। তাদের মধ্যে চিকিৎসক ২ হাজার ৯১১ জন, নার্স ২ হাজার এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন ৩ হাজার ২৯৬ জন। বিএমএর তথ্যমতে, গত বছরের জুন-জুলাই ও আগস্ট মাসে করোনার সংক্রমণ যখন তীব্র রূপ ধারণ করে, সে সময় সবচেয়ে বেশি চিকিৎসকের মৃত্যু হয়। সবচেয়ে বেশি ৪৫ জন চিকিৎসক মারা যান কেবল জুন মাসেই। এরপর ধীরে ধীরে সেটা কমে আসে। বিএমএর তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে মারা যান আট জন চিকিত্সক। কিন্তু এপ্রিলেই মারা গেছেন ১৭ জন চিকিৎসক। এ পর্যন্ত মোট ১৫১ জন চিকিৎসক করোনায় মারা গেছেন।
এদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট খুবই বিপজ্জনক। ভাইরাস তার রূপ দ্রুত পরিবর্তন করছে। আগামীতে যে নতুন রূপ আসবে, তা কতটা শক্তিশালী কেউ জানে না। ইতিমধ্যে অক্সিজেন রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। তবে ভারতে করোনার ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, লকডাউন কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। যখন মানুষ মাস্ক পরে না, স্বাস্থ্যবিধি মানে না, তখন সরকার লকডাউন দিতে বাধ্য হয়েছে, যার সুফলও মিলেছে। লকডাউনের কারণে করোনা রোগীর সংখ্যা কমেছে। কোনো কোনো হাসপাতালে করোনা রোগীদের সাধারণ বেড অর্ধেক খালি আছে। তবে কোনো হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি নেই। ইতালিতে যখন করোনার সংক্রমণ বেড়েছিল, ইতালির সরকার তখন চিকিৎসাসেবা সামাল দিতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তখন ইতালি সরকার সবকিছু স্রষ্টার ওপর ছেড়ে দেয়। আমেরিকাও দিশেহারা হয়েছিল। এমনকি চিকিৎসাবিজ্ঞানে আরো অনেক উন্নত রাষ্ট্র চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে বিপাকে পড়ে যায়। স্বাস্থ্যবিধি শতভাগ মানা এবং টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে ঐ সব দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণের পথে যাচ্ছে।
অনেক বিশেষজ্ঞই বলছেন, করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউ বাংলাদেশে শুরু হলে চিকিৎসা ও অক্সিজেনের অভাবে চোখের সামনে যখন রোগী মারা যাবে, তখন চিকিৎসকদের চোখের পানি ফেলা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে করোনার টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ টিকা তৈরির কাঁচামাল দেয়নি আমেরিকা। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, করোনা কবে নির্মূল হবে তা অনিশ্চিত। তাই বাঁচার জন্য মাস্ক পরুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। দয়া করে কেউ আর রোগী হবেন না। শুধু মাস্ক পরলেই ৮০ ভাগ নিরাপদ থাকা যায়। কিন্তু এই সহজ কাজটা অনেকে করছেন না কেন? ডাক্তাররা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর কত সেবা দেবেন? করোনা নিয়ে রাজনীতি করা ঠিক নয়। নিজে রোগী হয়ে ডাক্তারদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবেন না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশে বর্তমানে ৭ হাজার করোনা রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। এর চেয়ে তিন গুণ রোগী হলে পরিস্থিতি খুবই খারাপ হবে। আমরা এই পরিস্থিতির দিকে যেতে চাই না। তাই সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যায় প্রত্যেক করোনা রোগীর জন্য সরকারের দৈনিক ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। আর প্রতিটি আইসিইউর রোগীদের জন্য দৈনিক খরচ হয় ৫০ হাজার টাকা। সরকার সাধ্যমতো চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, সক্ষমতা রয়েছে ৭ হাজার রোগীর চিকিৎসার। সেখানে দুই থেকে তিন গুণ রোগী এলে পরিস্থিতি খারপ হবে এটাই স্বাভাবিক। চিকিৎসকেরা কতক্ষণ সেবা দেবেন? তাদেরও তো জীবন আছে। তাই রোগী যাতে আর না বাড়ে, সেজন্য সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। জীবিকার দাগিদে সরকার সবকিছু খুলে দিচ্ছে। তবে সব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে কোনো সমস্যা নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার কারণে লকডাউন দিয়েছে সরকার, যার সুফল এসেছে। এখন অনেক হাসপাতালে বেড খালি আছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজে বাঁচুন, অন্যকেও বাঁচতে দিন। সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল হক বলেন, লকডাউন সমাধান নয়। তবে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানে না, তাই বাধ্য হয়ে সরকার লকডাউন দিয়েছে। আমরা রোগী হতে চাই না, সুস্থ থাকতে চাই। তাই সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ১৯০ বেড এখন খালি আছে। এটা লকডাউনের সুফল। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মাস্ক পরতেই হবে। এর মাধ্যমে নিজে বাঁচুন, দেশ-জাতিসহ আমাদেরও বাঁচান।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নামজুল হক জানান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য ১০০ বেড খালি আছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, এখন করোনা রোগী কমে গেছে। করোনা রোগীদের জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ১৫০ বেডের ওপরে খালি আছে। এটা লকডাউনের সুফলতা। তিনি দেশবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন।