ধর্ষণের মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তির (মৃত্যুদন্ড) আইন করা হলেও এ-সংক্রান্ত মিথ্যা মামলার সাজা অপর্যাপ্ত। ফলে মিথ্যা মামলা দিয়ে অন্যকে ঘায়েলের চেষ্টাকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না। আর এরই সুযোগ নিচ্ছে একটি চক্র। পুলিশের তদন্তেও জানা গেছে, নারী নির্যাতন মামলার মধ্যে কিছু কিছু মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে। পারিবারিক বিরোধ বা প্রেমঘটিত বিষয় নিয়ে অনেকেই নারী নির্যাতন মামলা ঠুকে দেন। বর্তমানে ধর্ষণের মিথ্যা মামলায় সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর। অপরাধ বিশ্লেষক ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলছেন, ধর্ষণের মিথ্যা মামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে কঠোর সাজার বিধান করা উচিত। এতে মিথ্যা অভিযোগের প্রবণতা অনেক কমে আসবে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদন্ড হলো। এখন কেউ কেউ অন্যকে ফাঁসিয়ে দিতে বা হয়রানি করতে এর সুযোগ নিতে চাইবে। এ ধরনের প্রবণতা রোধে ধর্ষণের মিথ্যা মামলা করলে মামলাকারীর সাজাও দৃষ্টান্তমূলক হওয়া উচিত।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত) ২০০৩-এর ১৭ ধারায় মিথ্যা মামলায় শাস্তির বিধান রয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের ইচ্ছায় ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই আইনের কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেন, তাহলে মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি এবং যিনি অভিযোগ দায়ের করিয়েছেন সেই ব্যক্তি অনধিক ৭ বৎসর পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। এই ধারায় মিথ্যা অভিযোগের বিচার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে সম্পন্ন হবে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুযায়ী, আসামি খালাস পাওয়ার সময় বিচারক যদি দেখতে পান, মামলাটি হয়রানিমূলক ও মিথ্যা, তাহলে বাদীকে কারণ দর্শানোর নোটিসসহ ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন বিচারক। দন্ডবিধির ১৯১ ও ১৯৩ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্যদানের জন্য সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া দন্ডবিধির ২০৯ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডে দন্ডিত হতে হবে। এছাড়া দন্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি কারও ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে কোনো অভিযোগ দায়ের করলে অথবা কোনো অপরাধ সংঘটিত করেছে মর্মে মিথ্যা মামলা করলে মামলা দায়েরকারীকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা অর্থদন্ডে কিংবা উভয় দন্ড দন্ডিত করা যাবে। আর অভিযোগের বিষয় যদি এমন হয়, এর কারণে মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা সাত বছরের ওপর সাজা হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তাহলে অভিযোগকারীর সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড ও অর্থদন্ড হতে পারে।
গত ৬ অক্টোবর জয়পুরহাটে ধর্ষণের মিথ্যা মামলা দায়ের করায় মোছা. মুন্নুজান বিবি (৪৮) নামে এক নারীকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয় জয়পুরহাটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। জয়পুরহাট সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের রবিউল ইসলামের স্ত্রী মুন্নুজান অভিযোগ করেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক মোল্লার ছেলে মারুফ হোসেন মামলার বাদী মুন্নুজান বিবির অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে অপহরণ করে। ওইদিন থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত তাকে ধর্ষণ করা হয়। পরে মুন্নুজান আদালতে হাজির হয়ে মামলা চালাতে অপারগতা জানান এবং আসামিদের বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই বলে মামলা প্রত্যাহার করতে চান। ওই সময় আসামিপক্ষের আইনজীবী ও বিচারকের কাছে মামলার অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় তাকে এ সাজা দেওয়া হয়।
জয়পুরহাটে শিশু ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগে মামলা করায় মোরশেদুল সরকার নামে মামলার এক বাদীকে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ৫ বছরের কারাদন্ড দেয় জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৯ সালের ৪ এপ্রিল বাক-প্রতিবন্ধী কন্যাশিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে শিশুর পিতা মোরশেদুল একই গ্রামের মেহেদী হাসানের (৩৪) বিরুদ্ধে কালাই থানায় মামলা করেন। এরপর ৩১ মে পুলিশ আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে। বিচারকালে সাক্ষী ও বাদীকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং যুক্তিতর্কের পর্যায়ে আদালত প্রমাণ পায় যে, মেহেদী হাসানের সঙ্গে বাদী মোরশেদুলের জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ থাকায় তাকে ফাঁসাতে ধর্ষণের মিথ্যা মামলা করা হয়।
ধর্ষণের অভিযোগ এনে মিথ্যা মামলা করায় গত ২৩ জানুয়ারি পঞ্চগড়ে কেরামত আলী (৪৩) নামে এক ব্যক্তিকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয় পঞ্চগড়ের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। ২০১৬ সালের ৯ মার্চ পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার টেপ্রীগঞ্জ ইউনিয়নের রামগঞ্জ বিলাসী হাজারীপাড়া এলাকার কেরামত আলী তার পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ এনে তারই আত্মীয় মোশারফ হোসেনের (৪৬) বিরুদ্ধে মামলাটি করেন। ২০১৭ সালের ১১ জুলাই জেলার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে ওই শিশু নিজেই জানায়, মোশারফ হোসেন তার কোনো ক্ষতি করেননি। তার বাবা ও খালুর মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে মামলাটি হয়েছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড হলো। এর ফলে এই ধরনের অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে। এখন এর সুফল পেতে হলে দেখতে হবে বিচারের সঠিক প্রয়োগ, মামলার দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি এবং নিরীহ কোনো ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে মিথ্যা মামলা একটি স্বাভাবিক বিষয়। তবে এ নিয়ে ফৌজদারি আইনে যেমন সাজার বিধান রয়েছে, তেমনি দেওয়ানি আইনেও ক্ষতিপূরণের প্রতিকার রয়েছে। ধর্ষণের মামলার সাজা যেহেতু বেড়েছে, কারও সঙ্গে কারও শত্রুতা থাকলে মিথ্যা মামলা হওয়ার সম্ভবনাও অমূলক নয়। এ প্রবণতা যেন না বাড়ে সেজন্য আইনে বিশেষ কিছু থাকতে হবে। কেন না মিথ্যা মামলায় মানুষ সামাজিক, পারিবারিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। সাজাটা বাড়ালে মানুষ খুব সাবধানতা অবলম্বন করবে। তাই এ ধরনের প্রবণতা থেকে দূরে রাখতে মিথ্যা মামলার সাজা অন্তত ১০ বছর করা যেতে পারে।’
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দেশে শত্রুতাবশত অনেক মিথ্যা অভিযোগের মামলা হয়। এর মধ্যে অনেক ধর্ষণ মামলাও হয়। ধর্ষণ মামলার সর্বোচ্চ সাজা হয়েছে মৃত্যুদন্ড। এখন দেখা যাবে কাউকে ফাঁসিয়ে দিতে বা হয়রানি করতে ধর্ষণের অভিযোগ এনে অনেকের মধ্যে মামলার প্রবণতা বাড়বে। যারা ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ করবে এবং তা যদি আদালতে প্রমাণ হয়, তাহলে তাদের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক সাজার ব্যবস্থা রাখতে হবে। যাবজ্জীবন সাজার বিধান রাখলে এ প্রবণতা কমে আসবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় অনেকেই সামাজিক এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ ধরনের প্রবণতাকে রোধ করতে হবে। বিদ্যমান আইনে মিথ্যা অভিযোগে মামলার যে সাজা তা একেবারেই নগণ্য। মিথ্যা মামলা যে করবে তাকেও এভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। তাই মিথ্যা মামলার সাজাও বাড়ানো উচিত।’
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে ১৯ হাজার ৬৮৩টি, ২০১২ সালে ১৯ হাজার ২৯৫টি, ২০১৩ সালে ১৮ হাজার ৯১টি, ২০১৪ সালে ১৯ হাজার ৬১৩টি, ২০১৫ সালে ১৯ হাজার ৪৮৬টি, ২০১৬ সালে ১৬ হাজার ৭৩০টি, ২০১৭ সালে ১৫ হাজার ২১৯টি, ২০১৮ সালে প্রায় ১৭ হাজার, ২০১৯ সালে ১৫ হাজার, ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ৭ হাজারের মতো নারী নির্যাতন মামলা হয়েছে।
এ বিষয়ে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব মামলার তদন্তে পারিবারিক বিরোধ ও প্রেমঘটিত কারণে বেশকিছু মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আমরাও চাই ধর্ষণ মামলায় যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হয়। ধর্ষণ মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের আইনের কোনো অপব্যবহার হবে না। পুলিশ সঠিকভাবেই তদন্ত করবে। মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করলেই মিথ্যা মামলা কমে আসবে। এজাহার দায়েরের আগেই সুবিবেচনা প্রয়োগ করতে হবে। কারণ এজাহার একবার হয়ে গেলে সেটি আর সংশোধনের সুযোগ থাকে না।’
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘ধর্ষণের মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হলে বাদীর বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে সাজার মেয়াদ আরও বাড়াতে হবে। সমাজ ও পরিবারেরও মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু দন্ড দিয়ে অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘মৃত্যুদন্ড দিয়ে ধর্ষণ যেমন রোধ করা যাবে না, তেমনি কঠোর দন্ড দিয়েও মিথ্যা মামলা করার প্রবণতা থেকে নিবৃত্ত করা যাবে না। এজন্য বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পেশি শক্তির প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’