হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের সাবেক সহকারী কমিশনার নাদির হোসেন শামীমের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
রবিবার সচিবালয়ে তলব করা হয় নাদির হোসেন শামীমকে। এদিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব মো. জাহাঙ্গির হোসেনের অফিস কক্ষে দিনভর অভিযুক্ত এবং ভুক্তভোগীদের উপস্থিতিতে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়।
শামীম বর্তমানে যশোর জেলা প্রশাসনে সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার পশ্চিম শালীহর গ্রামের আবদুল কুদ্দুসের ছেলে। তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনা দুই নারীরই বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায়। তাদের মধ্যে একজন বর্তমানে পেশায় শিক্ষিকা এবং আরেকজন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্রী।
শামীমের প্রতারণার শিকার শিক্ষিকা জানান, এদিন সকাল ১১ টায় উপসচিব মো. জাহাঙ্গির হোসেন তার কাছ থেকে শামীমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মৌখিকভাবে শোনার পর তা লিখিত আকারে গ্রহণ করেন। তিনি অভিযোগের সাথে শামীমের সাথে অন্তরঙ্গ ছবি, মেসেঞ্জারে উভয়ের গোপন বার্তা আদান প্রদানের প্রিন্ট কপিসহ বিভিন্ন আলামত সংযুক্ত করে দেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই শিক্ষিকার সামনেই শামীমকে অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চান। শামীম অভিযোগকারী শিক্ষিকার সঙ্গে প্রেম ও শারীরিক সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন।
বিয়ে না করার সম্পর্কে শামীম বলেন, কলেজে পড়াশোনার সময় ওই নারী রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন, একাধিক ছেলেদের সাথে প্রেম ছিল। উপ সচিব শামীমের কাছে জানতে চান তার এসব কর্মকাণ্ড সরকারি চাকরির নীতিমালা ভঙ্গ হয়েছে কি না? উত্তরে শামীম তার দোষ স্বীকার করেন।
শিক্ষিকা বলেন, তিনি কোন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। এ ছাড়া শামীম ছাড়া পূর্বে কোন ছেলের সঙ্গেও তার প্রেমের সম্পর্কও ছিল না।
অপর অভিযোগকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর নিকট থেকেও মৌখিক এবং লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করেছেন উপ সচিব জাহাঙ্গির হোসেন। ওই ছাত্রী জানান, তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে শামীম বলেছেন, আমি নাকি তাকে একতরফা ভালোবেসেছিলাম। শামীম বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমার সঙ্গে যে বহুবার শারীরিক সম্পর্ক করেছে কথা অবলীলায় অস্বীকার করেছেন। উপ সচিবের কাছে তাদের প্রেম সংক্রান্ত কিছু আলামত দিয়েছেন জানান ওই ছাত্রী।
এদিকে শিক্ষিকার সাথে যাওয়া অপর এক ছাত্রী জানান, শামীম তার সঙ্গেও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে একপর্যায়ে তাকে বিয়ে করেছে জানানোর জন্য ওই শিক্ষিকার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। যাতে ওই শিক্ষিকা শামীমের সাথে সম্পর্ক ছেড়ে দেয়। কিন্তু শামীম পরবর্তীতে তাকে (ছাত্রী) বিয়ে না করে প্রতারণা করেছেন। তিনি শামীমের প্রতারণা সম্পর্কে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
অভিযোগকারীরা বলেন, শামীম সচিবালয়ে তার নব বিবাহিত স্ত্রীকে (সহকারী জজ) সঙ্গে নিয়ে যান। সহকারী জজ সচিবালয়ের বিভিন্ন কক্ষে দৌড়ঝাঁপ করতে দেখেছেন তারা।
উপসচিব সচিব ওই তিন নারীকে জানিয়েছেন তিনি অভিযোগ শুনেছেন। এসব অভিযোগ আরও তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অভিযোগকারী ওই শিক্ষিকা বলেন, সহকারী কমিশনার নাদির হোসেন শামীম হবিগঞ্জে চাকরি করার সময় ফেইসবুকের মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিচয় হয়। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ বছরের শুরুতে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সিলেটের একটি হোটেলে নিয়ে তার সঙ্গে রাত কাটান শামীম। পরে বিয়ের জন্য চাপ দিলে তাকে নানা ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়া হয়। তিনি আরও জানান, হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কাছে শামীমের বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও বিচারের বদলে পেয়েছেন ভয়ভীতি আর হুমকি।
ভুক্তভোগী এই নারী বলেন, ‘শুধু তাই নয়, শামীমকে হবিগঞ্জ থেকে ভোলায় বদলি করে আমার বিচার প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। তিনি কোথায় বদলি হয়েছেন সেই খবর জানতে সময় লেগেছে তিন মাস। এভাবেই দায় এড়িয়ে যান হবিগঞ্জ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। অপকর্মের কোনো বিচার না করে শামীমকে হবিগঞ্জ থেকে ভোলা জেলা প্রশাসনে বদলি করা হয়। হবিগঞ্জ ও গৌরীপুর থানায় মামলা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া মামলা নেওয়া সম্ভব নয় বলে ওই দুই থানার ওসি জানিয়ে দেন।’
তিনি আরও জানান, গত ২৩ জুলাই ভোলার জেলা প্রশাসক বরাবর শামীমের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণার অভিযোগ করেন। এর আগে পারিবারিকভাবে বিয়ের বিষয়টি মেনে নেওয়ার জন্য গত ৪ জুলাই তিনি শামীমের ময়মনসিংহের গৌরীপুরের বাসায় যান। সেখানে শামীমের পরিবারের লোকজন তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেন। মোবাইলে থাকা শামীমের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক সংক্রান্ত প্রমাণগুলো জোর করে মুছে দেন। খবর পেয়ে স্থানীয় পুলিশ, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক ও এলাকাবাসী ঘটনাস্থলে যান। তখন শামীমের বাবা আবদুল কুদ্দুছ বলেন, ছেলের সঙ্গে তাদের পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই।
ভুক্তভোগী এই শিক্ষিকার দাবি, তিনি ছাড়াও আরও পাঁচজন নারীর সঙ্গে শামীম বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কথিত প্রেমে জড়িয়েছেন। বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে প্রতারণা করেছেন। প্রতারিতদের মধ্যে আনন্দমোহন কলেজ, বদরুন্নেছা কলেজ ও কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ছাত্রী এবং চট্টগ্রামের এক নারী রয়েছেন।
শামীমের প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগকারী আরেক নারীর বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুরে। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্রী। ভোলার জেলা প্রশাসকের কাছে করা লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, ২০০৭ সালে শামীম গৌরীপুর সরকারি কলেজ হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করাকালীন আমার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি সে সময় গৌরীপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলাম। ২০০৯ থেকে ’১৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ময়মনসিংহের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গিয়ে আমার সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হয়েছেন শামীম। বর্তমানে আমি আনন্দমোহন কলেজের মাস্টার্সের ছাত্রী। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হন শামীম। গত ২০ ফেব্রুয়ারি আমি এক বান্ধবীকে নিয়ে বিয়ের দাবিতে শামীমের বাবার বাসায় অবস্থান নিই। কিন্তু অযৌক্তিক দাবি নিয়ে তাদের পরিবারকে নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযোগ এনে শামীমের বাবা উল্টো আমার বিরুদ্ধে গৌরীপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। এরপর শামীমের পরিবারকে অনুরোধের ঘটনাকে ‘ভয়ভীতি প্রদর্শন’ উল্লেখ করে তার ভাই কবীর হোসেন সুজন গত ২৩ ফেব্রুয়ারি আরেকটি সাধারণ ডায়রি করেন।
এদিকে শামীমের বিয়ের খবরে চট্টগ্রামের জান্নাত নামে আরেক নারী তার স্ত্রী বলে দাবি করেন। ওই নারীর দাবি, ধর্মীয় শরিয়া মোতাবেক বিয়ে করে শামীমের সঙ্গে আড়াই বছর ঘর-সংসারও করেছেন। তিনি এ অভিযোগটি মৌখিকভাবে গৌরীপুরের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও থানা-পুলিশকে অবহিত করেছেন।
শামীমের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভোলার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলম সিদ্দিক বলেন, ‘শামীম গত ১০ মার্চ এখানে যোগদান করেন। দুই নারী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালে তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে তদন্তের নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে বর্তমানে তিনি কোথায় কর্মরত আছেন তা আমার জানা নেই।’
তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, নাদির হোসেন শামীম বর্তমানে যশোর জেলা প্রশাসনে সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি একজন সহকারী জজকে দুই মাস আগে বিয়ে করেছেন।
প্রতারণার অভিযোগের বিষয়ে জানতে শামীমের দুটি ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নাম্বারে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।