অবশেষে দেশের কভিড হাসপাতাল কমাতে যাচ্ছে সরকার। করোনার রোগী অনুপাতে বেড খালি থাকার ওপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি তালিকা প্রস্তুত করেছে। সে তালিকা অনুযায়ী আপাতত ১২টি কভিড হাসপাতাল নন-কভিড করা হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকায় নয়টি, সিলেটের একটি ও চট্টগ্রামে দুটি হাসপাতাল রয়েছে। এসব হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের তাদের পুরনো কর্মস্থলে ও যেসব হাসপাতালে জনবল সংকট, সেখানে পাঠানো হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, গতকাল অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার তৈরি সে তালিকায় অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও হাসপাতাল শাখার পরিচালক স্বাক্ষর করেছেন। আজ বুধবার তালিকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা রয়েছে।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. ফরিদ হোসেন মিয়া গতকাল মঙ্গলবার রাতে বলেন, আমরা তালিকা করেছি। আগামীকাল (আজ) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাব। আশা করছি এ মাসের মধ্যেই এসব হাসপাতালকে নন-কভিড হাসপাতালে রূপান্তর করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ১২টি হাসপাতাল বন্ধের ব্যাপারে আমরা সুপারিশ করেছি। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার লালকুঠি মা ও শিশু হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, দুটি বেসরকারি কভিড হাসপাতাল, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, রেলওয়ে হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রামের হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালসহ দুটি হাসপাতাল। এ কর্মকর্তা আরও জানান, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা জাতীয় প্লাস্টিক অ্যান্ড বার্ন ইনস্টিটিউট, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কভিড হাসপাতাল হিসেবে চালু থাকবে।
এ কর্মকর্তা বলেন, শয্যা সংখ্যা, বরাদ্দকৃত কভিড শয্যা সংখ্যা, কতজন রোগী ভর্তি আছে, কতটা বেড ফাঁকা এসব তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তালিকা করেছি। এগুলোতে আমরা দেখেছি ব্যাপক আকারে শয্যা খালি আছে। কোনো হাসপাতালে ২০০ বেড আছে, রোগী আছে ১০টা। বেড আছে দুই হাজার, রোগী আছে ১৫টা। এভাবে অর্থ ব্যয় করার দরকার নেই। এসব হাসপাতালে যেসব অতিরিক্ত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী দেওয়া হয়েছিল, তাদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। যেসব হাসপাতালে সংকট আছে, সেখানে দেওয়া হবে। তবে বন্ধের ব্যাপারে দিনক্ষণ উল্লেখ করে কোনো সুপারিশ করা হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি কভিড-১৯ হাসপাতাল রয়েছে ২৮টি। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে কভিড হাসপাতালের সংখ্যা ১৬টি। বাকি ১২টি চার জেলায়। এর মধ্যে ঢাকা জেলায় একটি, নারায়ণগঞ্জে দুটি, গাজীপুরে একটি ও চট্টগ্রাম জেলায় আটটি কভিড হাসপাতাল রয়েছে। এসব কভিড হাসপাতালের মধ্যে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ১৯টি। বাকি ৯টি হাসপাতাল বেসরকারি। এর মধ্যে ঢাকা শহরে রয়েছে চারটি, নারায়ণগঞ্জে একটি ও চট্টগ্রামে চারটি।
তবে কভিড হাসপাতালকে নন-কভিড হাসপাতালে রূপান্তর করার ব্যাপারে করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি বলে জানিয়েছেন কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, হাসপাতাল বন্ধের বিষয়ে কোনো পরামর্শ নেওয়া হয়নি। পরামর্শক কমিটি হাসপাতাল বন্ধের বিষয়ে কোনো পরামর্শও দেয়নি। এখনই বন্ধ হলে লোকজনের ধারণা হবে, পরিস্থিতি বোধহয় ভালো হয়ে গেছে। এতে করে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাসহ যেসব স্বাস্থ্যবিধিতে সাধারণ মানুষ অভ্যস্ত হয়েছিল, সেগুলোতে ঢিলেমি আসবে। আমেরিকা, ইতালি, যুক্তরাজ্যে রোগী কমে যাওয়ার পর তাদের প্রস্তুতিতে, প্রতিরোধ কার্যক্রমে কিছুটা শিথিলতা এনেছিল। এ কারণে সেখানে সেকেন্ড ওয়েভ এসেছে। আর আমাদের দেশে যদি সেরকম হয়, তাহলে কিন্তু আমরা অসুবিধায় পড়ে যাব।
বিশেষজ্ঞরা এসব হাসপাতাল বন্ধের আগে সরকারকে পরবর্তী সময়ে এসব হাসপাতালে সব ধরনের রোগীর করোনা টেস্ট ও আইসোলেশন সেন্টার এবং কভিড ও নন-কভিড রোগীদের জন্য পৃথক আইসিইউ কর্নার রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, এসব ব্যবস্থা না থাকলে পরে এসব হাসপাতালে সাধারণ রোগীরা চিকিৎসার জন্য আসতে ভয় পাবে এবং আসবে না। এমনকি সরকার যেসব কারণে এসব কভিড হাসপাতাল নন-কভিডে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সে সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তারা বলেছেন, সরকারের উচিত হবে করোনার সঠিক বিজ্ঞানভিত্তিক সার্ভিলেন্স করে গতিপ্রকৃতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া। তা না হলে আগের মতোই সিদ্ধান্ত অদলবদল করতে হতে পারে।
এর আগে গত এক মাস ধরেই বিভিন্ন সময়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক রোগী কমে আসায় এবং হাসপাতালে বেড ফাঁকা থাকায় কভিড হাসপাতাল কমানোর কথা বলে আসছিলেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। রোগী আরও কমে গেলে এ মাসের শেষে কয়েকটি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল বন্ধ করে নন-কভিড হিসেবে ঘোষণা করা হবে।
এ ব্যাপারে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও সরকার সমর্থিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যেভাবে কভিড হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি বলছে, সেটা ঠিক নয়। যেমন বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে বলছে ২৬টা ভেন্টিলেটর, আসলে সেখানে অ্যাকটিভ ১৬টা। এরকম বিভিন্ন হাসপাতালে অচল ভেন্টিলেটরের কারণে শয্যাসংখ্যা শূন্য, সেগুলোকে খালি দেখানো হচ্ছে। আসলে কোনো ভেন্টিলেটরই খালি নেই। ফলে কভিড হাসপাতাল গোটানোর যে সিদ্ধান্ত, সেটা খুব ভালোমতো যাচাই-বাছাই করে করা উচিত। গোটানোর চেয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাটা ঠিক করা উচিত।
এখন বন্ধ করলেও করোনা রোগী বাড়লে এসব হাসপাতাল যেন দ্রুত কভিড হাসপাতালে রূপান্তর করা যায়, সে ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, কাজেই কোনো হাসপাতাল একেবারেই বন্ধ করা যাবে না। বিশেষ করে সব হাসপাতালেই কঠোরভাবে সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা রাখতে হবে।