আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম ও সাহারা খাতুনসহ পাঁচ সংসদ সদস্যের (এমপি) মৃত্যুতে শূন্য হওয়া আসনের উপনির্বাচনে দলটির প্রার্থী হতে আগ্রহী ১৪১ জন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ মনোনয়নপ্রত্যাশী ঢাকা-১৮ আসনে ৫৬ জন আর সর্বনিম্ন তিন জন সিরাজগঞ্জ-১ আসনে। এ পাঁচ আসনের উপ-নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীর ছড়াছড়িতে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা। তারা বলছেন, নির্বাচন এলেই দলে সৃষ্টি হওয়া এ পরিস্থিতি একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাবে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে যোগ্য-অযোগ্য সবার ভেতরে তৈরি হয়েছে এমপি হওয়ার প্রত্যাশা। এই অশুভ লড়াইয়ের বিরুদ্ধে দলকে কঠোর হতে হবে।
ক্ষমতাসীন দলটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, পাঁচটি আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থীর ছড়াছড়ি কার্যত অসুস্থ প্রতিযোগিতাই প্রমাণ করে। এত প্রার্থীর মধ্যে বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে বড়জোর ১০ জনের এমপি হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে। বাকিদের মেম্বার-চেয়ারম্যান হওয়ার মতো ত্যাগও দলের জন্য নেই। অবস্থা এমন হয়েছে যে, বছরখানেক রাজনীতি করেনি কিন্তু এমপি হতেই হবে। এরই অংশ হিসেবে দেখা যায়, কোথাও শূন্য আসনে উপনির্বাচনের সুযোগে নিজেকে ত্যাগী প্রমাণ করার এক ধরনের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন অনেকে। শুধু তাই নয়, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চরিত্র হননের চেষ্টা শুরু হয় তাদের মধ্যে। ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেমন ত্যাগী প্রমাণ করার লড়াই শুরু হয়, তেমনি এসব মাধ্যমে চরিত্র হননের জোর তৎপরতা দেখা যায়। এরা সবাই নিজের কাছে নিজে যোগ্য ও ত্যাগী।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘নির্বাচন এলে এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয় মনোনয়নপত্র কেনার। দলের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিতে যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক সব প্রার্থী নিজেকে যোগ্য মনে করেই মনোনয়নপত্র কেনেন। এটি এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তবে এতে দলীয় তহবিল বৃদ্ধি পায়।’
কেন্দ্রীয় নেতাদের আরেক অংশের ভাষ্য, মনোনয়নপত্র কে কিনতে পারবেন, কে পারবেন না এমন কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় সবাই তা কেনেন। এতে অন্তত একটি লাভ হয় দলের জন্য তা হলো মনোনয়নপত্র কেনাবেচার মধ্য দিয়ে দলীয় তহবিল বৃদ্ধি পায়।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, ‘দল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে কিছু সুযোগসন্ধানী নেতাকর্মী আর্থিকভাবে সচ্ছল হয়েছে। আর্থিক সচ্ছলতা আসায় তাদের ভেতরে অসুস্থ প্রতিযোগিতার প্রবণতা বেড়েছে। অথচ দলের জন্য তাদের ত্যাগ কী, লড়াই-সংগ্রামে কী ভূমিকা পালন করেছে এগুলো যাচাই-বাছাই করলে দেখা যাবে মনোনয়নপত্র কেনার যোগ্যতা পর্যন্ত হয়নি। অথচ প্রার্থীর হওয়ার মতো সাহস দেখাচ্ছেন তারা। এটা আসলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা।’ তিনি আরও বলেন, ‘অবশ্য মনোনয়নপত্র যে কেউ নিতে পারেন। কিন্তু এখানে রাজনৈতিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। প্রত্যাশিত প্রার্থীদের ভেতরে নিজেদের ত্যাগ-দক্ষতা এসব বিবেচনাবোধ না থাকলেও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড প্রার্থীর দলের জন্য ত্যাগ বিবেচনায় নিয়েই চূড়ান্তভাবে মনোনীত করা হয়।’
এভাবে দলীয় তহবিল বৃদ্ধি পেলেও এ ব্যাপারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অনেকখানি কমে গেছে। যদি তা থাকত তবে একটি এলাকায় সিনিয়র-ত্যাগী কেউ মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলে উচিত হতো ওই সিনিয়র নেতাকে সম্মান দেখিয়ে জুনিয়র অন্য কারও মনোনয়নপত্র সংগ্রহ না করা। এমপি না হয়েও রাজনীতি করার সুযোগ তো আওয়ামী লীগে অনেক বেশি।’ পাঁচটি আসনের উপনির্বাচনের জন্য ১৪১ জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন জেনে বিস্মিত আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘শূন্য হওয়া আসনে এমপি কে ছিলেন, এটা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ভাবা উচিত।’
গত ১৩ জুন মারা যান সিরাজগঞ্জ-১ আসনের এমপি আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম। পরে ৯ জুলাই মারা যান ঢাকা-১৮ আসনের এমপি দলের সভাপতিম-লীর সদস্য সাহারা খাতুন। ঢাকা-৫ আসনের এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লা মারা যান ৬ মে, পাবনা-৪ আসনের এমপি শামসুর রহমান শরীফ ডিলু ২ এপ্রিল এবং সর্বশেষ গত ২৭ জুলাই মারা যান নওগাঁ-৬ আসনের এমপি ইসরাফিল আলম। তাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া এই পাঁচ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের আগ্রহী প্রার্থীদের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল গত ২৩ আগস্ট। দলটির দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পাঁচটি আসনের মধ্যে ঢাকা-১৮ আসনে সর্বোচ্চ ৫৬ জন, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নওগাঁ-৬ আসনে ৩৪, পাবনা-৪ আসনে ২৮, ঢাকা-৫ আসনে ২০ এবং সর্বনি¤œ ৩ জন সিরাজগঞ্জ-১ আসনে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন। প্রতিটি ফরমের মূল্য ৩০ হাজার টাকা হিসাবে দলীয় তহবিলে জমা পড়েছে ৪২ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ-১ আসনে প্রয়াত নাসিমের ছেলে তানভীর শাকিল জয়, নাসিমের বড়ভাই মোহাম্মদ সেলিমের ছেলে শেহরিন সেলিম ও ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি অমিত কুমার দেব মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। ঢাকা-১৮ আসনে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন যুব মহিলা লীগ সভাপতি নাজমা আক্তার, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হাবিব হাসান, নাজিম উদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের খান, মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নাসিমা ফেরদৌসী প্রমুখ।
ঢাকা-৫ আসনের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মন্নাফী, ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রয়াত হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে মশিউর রহমান মোল্লা সজল, যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী মনিরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ মুন্না, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি কামরুল হাসান রিপন প্রমুখ।
পাবনা-৪ আসনের প্রয়াত এমপি ডিলু পরিবারের ৫ জন মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। তারা হলেনতার স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফ, ছেলে গালিবুর রহমান শরীফ, মেয়ে মেহজাবিন শিরিন পিয়া, জামাতা আবুল কালাম আজাদ মিন্টু ও খালাতো ভাই বশির আহমেদ। এছাড়াও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন রবিউল আলম বুদু, এ এস এম নজরুল ইসলাম, সৈয়দ আলী জিরু প্রমুখ।
নওগাঁ-৬ আসনে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন প্রয়াত ইসরাফিলের স্ত্রী সুলতানা পারভীন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক, জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আসাদুজ্জামান প্রমুখ।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর পাবনা-৪ আসনের উপনির্বাচনে ভোট হবে। ঢাকা-৫ ও নওগাঁ-৬ আসনে উপনির্বাচন হবে ১৭ অক্টোবর। ঢাকা-১৮ ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনে নির্বাচনের তফসিল এখনো ঘোষণা করা হয়নি।