করোনা আতঙ্কে যখন অনেক হাসপাতাল, ক্লিনিক এমনকি ডাক্তার তাদের সেবা গুটিয়ে নিয়েছে তখন কিছু চিকিৎসক তাদের দ্বায়িত্ববোধ আর নৈতিকতার জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছেন অবিরত। এই সেবা শুধু ব্যবসার প্রসারের জন্য নয় সামাজিক দ্বায়বদ্ধতার জায়গা থেকে। এমনি একজন ডাক্তার এস.আর হোমিও হল, কুষ্টিয়ার ডাঃ রিয়াজুল করিম। তিনি চিকিৎসা পেশাকে সেবা হিসেবে নিয়েছেন বলেই অনেক গরীব রোগীর ঔষধ পত্র বিনামূল্যে সরবরাহ করে থাকেন। বর্তমানের এই করুন পরিস্থিতিতে কুষ্টিয়ায় পূর্ণরূপে চালু থাকা কয়েকটি চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রের মধ্যে তার এস.আর হোমিও হল একটি।
তার সাথে কাজের ফাকে বর্তমানের করোনা পরিস্থিতি, চিকিৎসা সেবা ও হোমিও চিকিৎসার নানা অজানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়। সম্প্রতি এপিএস নিউজকে একজন হোমিওপ্যাথি প্রাকটিশনার হিসাবে তার স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন, সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আইনী পাঠশালা টিম ।
প্রশ্নঃ শুনা যাচ্ছে অনেক প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসকরা গ্রামের বাসায় গিয়েছেন কিন্তু আপনি কেন চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাচ্ছেন?
ডাঃ রিয়াজুল করিমঃ– চিকিৎসক হিসেবে এটি সত্যিই লজ্জার । আমাদের মাঝেই যদি সংস্কার না থাকে তাহলে সাধারণের সেবা করবো কিভাবে? করোনা রোগ একজন থেকে আর একজনে ছড়ায় ঠিক আছে কিন্তু কিছু সাবধনতা অবলম্বন করলে সে পথ রোধ করা যায়। অনেকেই এখন হাঁচি, কাশির রোগী দেখে করোনা সেটা মনে করা কখনও -ই ঠিক হবে না, কারন স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের বর্তমানে যে আবওহায়া, যেমন সন্ধ্যা রাতে গরম পড়ছে আপনি ফ্যান চালিয়ে ঘুমিয়েছেন সকালে ঠান্ডার মাত্রা বেড়ে গেছে।তখন আপনার ঠান্ডা লাগতেই পারে এবং তাতে শুরুটা কিন্তু হাঁচি কাশি দিয়েই হবে।তার মানে এই না,যে আপনার করোনা হলো।তাছড়াও আমাদের দেশে অনেক মানুষ আছেন যাদের কোল্ড এ্যালার্জী আছে। যাদের কোল্ড এ্যালার্জী থাকে তাদের রক্তে Ige এর মাত্রা বেশী থাকে।যে কোনো মানুষের দেহে Ige এর মাত্রা বেশী থাকলে তাদের সামান্য ঠান্ড লাগতেই হাঁচি হবেই।সুতরাং হাঁচি কাশি দেখলেই করোনা হয়েছে ভাবার সুযোগ নেই,তবে অবশ্যই বর্তমান প্রেক্ষিতে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। এখন বাস্তবতা ঠিক এমন,সবাই মনে করছে আমি বাদে সবাই করোনা ভাইরাসের বাহক।যা সত্যিই দুঃখের এবং হতাশারও বটে। আবার অন্যান্য রোগে যারা আক্রান্ত তাদের চিকিৎসা সেবা দিতে তো কোন সমস্যা নেই। অনেকেই বলে চিকিৎসা একটি সেবার নাম কিন্তু এমন কর্মকান্ড আমাদের লজ্জার ।
প্রশ্নঃ আপনি কি বাধ্য হয়ে সেবা দিচ্ছেন ?
ডাঃ রিয়াজুল করিমঃ– প্রশ্নই উঠেনা!কারন আমি একজন চিকিৎসক,সেবাই আমার পেশা,সেবাই আমার ধর্ম। আমার এই মূহুুর্তে একজন ইউরোপিয়ান চিকিৎসক জন ফ্রান্সিস্কের কথা মনে পড়ছে,তার সাথে আমার জার্মানীতে একটি সেমিনারে কথা হয়েছিলো ।তার বক্তব্য হলো আপনি ডাক্তার, আপনি সৃষ্টিকর্তার মূল সৃষ্টির সেবক।অর্থাৎ আপনি সৃষ্টিকর্তার প্রতিনীধি। আপনার আচার আচরণ স্বভাব চরিত্র কাজকর্মের মধ্যে যদি তার বৈশিষ্ট্য না থাকে,তবে আপনি সেবক নাএক কথাই আপনি ডাক্তার না।বড় জোর,আপনাকে টাকা কামানোর মেশিন বলা যেতে পারে। কথাটা অনেক কঠিন এবং চিকিৎসকের এটি বর্জন করার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি।সুতরাং আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি দেশের এবং দেশের মানুষের এই দূর্সময়ে আমি স্বাভাবিক নিয়মের চেয়ে বেশী সেবা দেওয়ার জন্য আমার বিবেকের কাছে অঙ্গিকার করেছি।মৃত্যু যদি এভাবেই হয়,তবে সেটাই হবে আমার কিয়ামতের দিন নাজাতের কারণ (আলহামদুলিল্লাহ) চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাবার নির্দেশনা অবশ্যই আছে । কিন্তু অনেকেই তো তা মানছে না । আসলে তারা মানতে চাচ্ছে না। আর এ নির্দেশনা থাকুক বা না থাকুক চিকিৎসা সেবা এই মুহূর্তে সবার আগে । কিন্তু আমরাই যদি বিপদের সময় নিজেকে গুটিয়ে নেই তাহলে আমাদের চিকিৎসক পরিচয় না দেওয়াই ভালো। আমার বিবেকবোধ থেকে মূলত আমি মন থেকে আজো চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি এবং যতদিন পারি নিরলস কাজ করে যাবো।
প্রশ্নঃ করোনা থেকে বাচতে আপনি নিজেও কি কোন সতর্কতা অবলম্বন করছেন?
ডাঃ রিয়াজুল করিমঃ– হ্যা, Prevention is better than cure. আর করোনার ক্ষেত্রে তো এটা কোন সন্দেহ ছাড়াই বলা যায়। আমি নিজেও যেমন করোনা প্রতিরোধে নির্দেশনাগুলো মেনে চলছি তেমনি অন্যদের উৎসাহিত করছি। আমি ডাঃ বলে আমি আক্রান্ত হবো না এমনটা তো হতে না। সবাইকে নিজ নিজ স্থান থেকে তার দ্বায়িত্ব পালন করতে হবে। কোন ভাবেই নিজের দ্বায়িত্ববোধ অবহেলা করে অপরাধী হওয়া ঠিক হবে না।
প্রশ্নঃ করোনার ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থা কি অবদান রাখতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ডাঃ রিয়াজুল করিমঃ– আপনি আমাকে হাসালেন! আমার দেশ,আমার জনগণ বিপদে! আমার উপকরন কম,তাই বলে আমি কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবো? কখনও না, আমার চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা বলার আগে আপনাকে একটি গল্প শুনাই। আপনার বাড়ীতে মেহমান এসছে।বাসায় পান্তাভাত ছাড়া তেমন কিছুই নেই।আপনার সাধ্যও নেই। তাঁকে আপনি কি বলবেন?তাঁকে কি বলবেন ” আপনি কেনো এমন দিনে এলেন?না কি বলবেন।আজ পান্তাভাত তাই আপনাকে দিলাম না।পরে একদিন আসবেন,পোলাও খাওয়াবো!কখনও না বরং আপনি সেদিন পারলে আরও বেটার কিছু খাওয়াবেন,তবে অবশ্যই আজ তাঁকে পান্তাভাত হলেও খাওয়াতে হবে। এরই নাম দ্বায়বদ্ধতা! সুতরাং আমি আমার যা আছে তা নিয়েই করোনার চিকিৎসা করে যাবো বলে আশা করছি ইনশা আল্লাহ। করোনা নিয়ে আমার নিজস্ব ভাবনাটা বলি।আমি মানুষটা ব্যাক্তিগত ভাবে হতাশ না বরং অনেক বেশী আশাবাদী। কারন আমি কঠিন ভাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করি। সেখান থেকেই বলছি।
১. আমাদের দেশে তাপমাত্রা বেশী,আমাদের ফুডহ্যাবিট একটি ফ্যাক্টর,কারন আমরা শুকনা ঝাল,আদা,রশুন,গোলমরিচ সহ কিছু মশলা পরিমানে বেশী খায়,এটা একটি প্রতিরোধের কাজ করবে।
২. আমি ইউরোপের অনেক জায়গাতে ঘুরেছি,সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি,ওরা বরফ শীতল পানি খায় সারা বছর,তাতে করে ওদের চেয়ে আমাদের ফুসফুসের শক্তি আল্লাহ বেশী দিয়েছেন।
৩. আমাদের আবহাওয়া বেশী আদ্র এবং পলুটেড,সেই কারনে এটার বিস্তার কম হওয়ার একটি সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং আপনি আল্লাহ’র ভরসা করে সরকার নির্দেশিত উপায়ে সতর্ক থাকুন,সচেতন থাকুন। এর পরে আমাদের মেডিসিন! আল্লাহ ভরসা।আমাদের যে চিকিৎসা ব্যাবস্থা আছে তাতে করোনার রোগীরা যদি শুরুতেই চিকিৎসা নেন এবং নিয়ম মানেন সেই ক্ষেত্রে আমরাও একটি ভূমিকা রাখতে পারবো করোনা চিকিৎসাতে।
প্রশ্নঃ বর্তমান চিকিৎসা ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথির চিকিৎসায় প্রতিবন্ধকতা কি?
ডাঃ রিয়াজুল করিমঃ– আমাদের চিকিৎসা সেবা আরো বেশী কার্যকর করার জন্য যে ধরনের ঔষধ দরকার তেমন ঔষধ আমাদের দেশের হোমিওপ্যাথিক কোম্পানী গুলো তৈরী করতে সক্ষম না। এর কিন্তু মূল কারন আমরা আজও সৎ মানুষ হতে পারিনি।সৎ মানুষ ছাড়া ভাল ঔষধ তৈরী হতে পারে কি করে।সবাই চায় টাকা কামায় করতে। জটিল এবং কঠিন চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা শতভাগ বিদেশ নির্ভর। আবার অনেক ক্ষেত্রে বাজারে ভেজাল ঔষধ পাওয়া যায়। সরকার এ বিষয়ে সুদৃষ্টি দিলে আমরা আরো কম খরচে অনেক কার্যকরী সেবা প্রদান করতে পারবো।
প্রশ্নঃ হোমিও প্যাথির সাফল্য এবং ব্যার্থতার দিক কি?
ডাঃ রিয়াজুল করিমঃ– হোমিওপ্যাথিতে সাফল্যের চেয়ে ব্যার্থতা অনেক কম।ব্যার্থতার কথা একটিই বলবো,সেটা হলো আমাদের জ্ঞানের পরিধি কম,সেটা বাড়াতে হবে। সেই ক্ষেত্রে দরকার সরকারে সু-নজর ও হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন যারা তৈরী করেন তাদেরকে তদারকি করতে হবে। তবে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় পরীক্ষানিরীক্ষা খুবই কম দরকার হয়।অনেক ক্ষেত্রেই জরুরী হয়ে পড়ে যেমন জন্ডিস, কিডনী, ইনফার্টিলিটি ইত্যাদি।যেখানে দরকার সেখানে করাতে হবে। আমাদের এখানে রোগ লক্ষণ জানা এবং বুঝতে পারাটা খুবই জরুরী। তবে আমি ব্যাক্তিগত ভাবে চিকিৎসকদের অকারনে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একজন মানুষের ক্ষতি করে কমিশন খাওয়াকে প্রচন্ডভাবে ঘৃনা করি।এটা একটি কঠিন অপরাধ এই বিষয়টি সরকার নিয়ন্ত্রন করতে পারলে আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যায় ৪৫-৫০% কমে যাবে। আমরা এখনও চিকিৎসাক্ষেত্রে অনেকের কাছেই চরম এবং পরম আস্থার জায়গা।আপনি একটু সার্চ করলেই পাবেন,হয়তবা আপনারই কোনো আপন জনের কাছে এখনও আমাদের প্রতি রোগীদের আস্থা এবং বিশ্বাস অনেক বড়।এমন অনেক অনেক মানুষ আছেন,তারা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সেবাতেই নিজেকে সুস্থ রেখেছেন।
প্রশ্নঃ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা সেবা আরো সহজলভ্য করার জন্য কোন পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
ডাঃ রিয়াজুল করিমঃ– আসলে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সেবা যথেষ্ঠ্য সহজলভ্য আছে বলে আমি মনে করি। এখানে দরকার হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের বিভিন্ন ভাবে ট্রেনিং করিয়ে আরও জ্ঞানের পরিধি বাড়ানো । দরকার হোমিওপ্যাথিক নিয়ে পড়ালেখা করার আরও সুযোগ তৈরী করা। দরকার হোমিওপ্যাথিক গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা।দরকার হোমিওপ্যাথিক ঔষধ শিল্পকে মনিটারিং করে মেডিসিনের গুণগত মান বাড়ানো। যে মানটা হবে আন্তর্জাতিক মানের। তা না হলে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সেবা আতুর ঘরেই রয়ে যাবে। আর এই চিকিৎসার মান বাড়াতে হলে দরকার সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা।
প্রশ্নঃ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এক কথায় কিভাবে এগিয়ে নেয়া যায় যদি বলতেন?
আমরা যারা এই পেশায় আছিতারা নিজেদের নিয়ে-ই পেরে উঠিনা সেখানে গবেষণা কি করে সম্ভব? আমরা পেটের চিন্তা করবো?না গবেষণা করবো? তবে আমি আপনাকে একটি বিষয় জোর গলায় বলতে পারি। একমাত্র সার্জারী বাদ দিয়ে আমরা এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা থেকে তেমন একটা পিছিয়ে নেই। বরং এই সব ক্ষত্রে চিকিৎসা খরচ তাদের তুলনায় আমাদের ৫% ও না। কিন্তু সফলতা তাদের চেয়ে কোনো দিক দিয়ে কম না। তাদের এন্টিবায়োটিক যে পরিমান ক্ষতি করে মানব দেহে সেটা রিকোভারি করা একজন মানুষের পক্ষে অসম্ভব। পক্ষান্তরে আমাদের মেডিসিন কখনওই এমন ক্ষতি করবে না। শুধু গবেষণা ও ভাল মানের ডাক্তার তৈরি করার মাধ্যমে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকে জনপ্রিয় করে তোলা সম্ভব।
প্রশ্নঃ আল্লাহ আপনাকে ভালো রাখুন। এবং এপিএস নিউজকে সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
ডাঃ রিয়াজুল করিম -আপনাকেও ধন্যবাদ