মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
করোনাকালে সারা বিশ্ব ও তার মানুষ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যুস্ত। তা স্বত্তেও চিরাচরিত নিয়মে চান্দ্রমাসের হিসাবে ঈদুল আজহা আমাদের দুয়ারে কড়া নাড়ছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের ২য় সব্বোচ্চ ধর্মীয় উৎসব। তবে এটি শুধু আনন্দের নয় এখানে আত্নত্যাগের মহিমা ও নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিষকে সমর্পণ করার যে ইসলামের ইতিহাস তা সকলেরই জানা। তাই আমি হযরত ইবরাহিম আঃ ও তার পুত্র ইসমাইল আঃ এর যে কাহিনী পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে তা বিস্তারিত বলবো না। শুধু ওই ঘটনার মধ্যে কি শিক্ষা অর্ন্তনিহিত ছিল তা নিজের মতো করে বর্ণনা করবো। কুরবানী শব্দের অর্থ বা শানে নুযুল জানা এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। কুরবানির বিধান যুগে যুগে সব শরিয়তেই বিদ্যমান ছিল। মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে প্রমাণিত যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর দরবারে তার প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করতেন। উদ্দেশ্য একটাই- আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানির এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওই সব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যা আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন।’ (সুরা হজ : আয়াত ৩৪)।
কিন্তু আমরা কি দেখছি মানুষ এখন তার জীবন যৌবন পার করে দিচ্ছে দুনিয়াতে তাঁর অবৈধ সম্পদ অর্জনের পিছনে। রিজেন্টের সাহেদ, জেকেজি এর আরিফ ও ডাঃ সাবরিনা এরা সমাজে ভদ্রতার মুখোশ পরে নিজেদের মেধাকে প্রতারণা ও অপকর্ম করার কাজে ব্যয় করলো। তারা তাদের দক্ষতাকে নীতিহীন ব্যবসায় বিনিয়োগ করলো সততা কে ভুলে গিয়ে যার পরিণতি তারা ভোগ করছে। এরা তাদের মেধাকে কুরবানি করলো কিন্তু খারাপ দিকে। তাদের এই নীতিহীন মেধা আমাদের না কোন কাজে আসলো এবং তাদেরও না কোন কাজে লাগছে। এই তো জীবন। কি হবে এতো অর্থ যা মৃত্যুকালে কোন কাজেই আসছে না।
কুরবানি শব্দের আভিধানিক অর্থ? আরবি করব বা কুরবান (قرب বা قربان) শব্দটি উর্দূ ও ফার্সীতে (قربانى) কুরবানি নামে রূপান্তরিত। এর অর্থ হলো-নৈকট্য বা সান্নিধ্য। কুরআনুল কারিমের কুরবানির একাধিক সমার্থক শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।>>نحر অর্থে। আল্লাহ বলেন, فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ ‘সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের জন্য নামাজ এবং কুরবানি আদায় করুন। এ কারণে কুরবানির দিনকে يوم النحر বলা হয়। >> نسك অর্থে। আল্লাহ বলেন, قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ ‘আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু; সবই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার জন্য।’ (সুরা আনআ’ম : আয়াত ১৬২)>> منسك অর্থে। আল্লাহ বলেন, ‘ لِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكاً ‘আমি প্রত্যেক উম্মাতের জন্য কুরবানির বিধান রেখেছি।’ (সুরা হজ্জ : আয়াত ৩৪)। >> الاضحى অর্থে। হাদিসের ভাষায় অর্থে কুরবানির ঈদকে (عيد الاضحى) ‘ঈদ-উল-আজহা’ বলা হয়।
কুরবানি সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশনা এ রকম যে, কুরবানির হলো আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জনের অনন্য মাধ্যম। কুরবানির শুরু হয়েছিল হজরত আদম (আঃ) সালামের দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের মধ্যে সংঘটিত করবানির মাধ্যমে।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে রাসূল! আপনি তাদেরকে আদমের পুত্রদ্বয়ের বৃত্তান্ত যথাযথভাবে পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই কুরবানি করেছিল, তখন একজনের কুরবানি কবুল হ’ল এবং অন্যজনের কুরবানী কবুল হ’ল না। সে (কাবিল) বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন (হাবিল) বলল, অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকিদের কুরবানি কবুল করেন। সে (হাবিল) বলল, যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবুও আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার প্রতি হস্ত প্রসারিত করব না। কেননা আমি বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি।’ সুরা মায়েদা : আয়াত ২৭-২৮) এ হলো কুরবানি কবুল হওয়া ব্যক্তির ভাবাবেগ ও মানসিকতা। কেননা কুরবানি তাকওয়াবান লোকদের আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অনন্য নিদর্শন।
কুরবানির প্রচলন হজরত আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকে শুরু হলেও মুসলিম উম্মাহ কুরবানি মূলতঃ হজরত ইবরাহিম (আঃ) আল্লাহর সন্তুষ্টির পরীক্ষায় হজরত ইসমাইল (আঃ) কে কুরবানির স্মৃতিময় ঘটনা নিজেদের মধ্যে বিরাজমান করা। আল্লাহ তা’আলা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় ফেলেছিলেন এ কুরবানির নির্দেশ প্রদান করে। যা তিনি হাসিমুখে পালন করে আল্লাহর প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যখন ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম) কে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করলেন, তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে মাবনজাতির নেতা বানিয়ে দিলাম।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১২৪).
কুরবানির প্রচলন এর প্রয়োজনীয়তা এবং কেন এই কুরবাণীর প্রচলন আর তা হলো; হজরত ইসমাইল (আঃ) যখন চলাফেরা করার বয়সে উপণীত হলেন; তখন হজরত ইবরাহিম (আঃ)তাঁর প্রাণপ্রিয় সন্তানকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানির জন্য স্বপ্নে আদিষ্ট হন। আর নবিদের স্বপ্নও কোনো কল্পনা প্রসূত ঘটনা নয় বরং তা ‘ওহি’ বা আল্লাহর প্রত্যাদেশ। তখন হজরত ইবরাহিম (আঃ) পুত্র ইসমাইলকে বললেন, ‘হে ছেলে! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে জবেহ করছি। এ বিষয়ে তোমার অভিমত কি? সে (হজরত ইসমাইল (আঃ) বলল, ‘পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’ (সুরা সাফফাত : আয়াত ১০২)
সবাই জানি কুরবাণির জন্য আল্লাহর হুকুম প্রাপ্তির সময় হজরত ইবরাহিম (আঃ) তখন ৯৯ বছরের বৃদ্ধ । তিনি ও তার প্রাণপ্রিয় পুত্রকে আত্মনিবেদনে আল্লাহ তা’আলা উভয়কে পরীক্ষার সম্মুখীন করেছিলেন। আর তিনিও মিনা প্রান্তরে সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে কুরবানির সে নির্দেশ পালন করেছিলেন।আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে তাঁর মানসিকতা আল্লাহর নিকট কবুল হয়ে গিয়েছিল। যা আজও মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর জিলহজ্ব মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ এ তিন দিনের যে কোনো একদিন পালন করে থাকেন। আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মাহকে লোক দেখানোর জন্য কুরবানির প্রচলন করেন নাই। বরং পশুকে জবাইয়ের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে মনের পশু ও আমিত্বকে জবাই করার তাওফিক দান করার শিক্ষা দিয়েছেন।কুরবানির মাধ্যমে নিজেকে মুত্তাকী ও পরহেজগার হিসেবে তৈরি করার তাওফিক ও সক্ষমতা দান করুন।
আমাদের কুরবানির শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। সত্য কথা হলো আমরা কুরবাণির যে প্রকৃত শিক্ষা তা মুসলিম হিসাবে গ্রহণ করতে পারিনি। বরং নীতিগত শিক্ষায় ও নৈতিকতার উৎকর্ষতায় নিদারুনভাবে দৈনতা প্রকাশ পেয়েছে। কুকর্মে ও অন্যায় কাজে নিজের জীবন যৌবন কুরবানি করছি । কোন ভালো কাজে বা ত্যাগে নিজেকে সমর্পণ করছি না। নিজের যা আছে তা ভালো কাজে উৎসর্গ করার মাঝে যে স্বর্গীয় সুখ তা শুধু দুনিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না আখিরাতেও পাথেয় হবে। বিন্তু বাস্তবতা হলো আমরা শুধু গরু ছাগল কুরবান করে গোশত খাওয়াকে ঈদ বানিয়ে নিলাম কাজের কাজ কিছুই হলো কি? মনে হয় হয়নি তাহলে এতো এতো দুর্নীতিবাজ, প্রতারক, চোর বাটপার এবং মুখোশধারী পয়দা হতো না এবং পর্দা, বালিশ, মাস্ক কান্ড দেখতে হতো না। যাইহোক আমরা অন্তত এই করোনাকালে কুরবানির ঈদকে সামনে রেখে প্রতিজ্ঞা করতে পারি আমরা কোন দুর্নীতিবাজ ও প্রতারক লোক হতে চাই না। যারা দুর্নীতিগ্রস্থ, প্রতারক ও ত্রাণ, ভোট ও চাল চোর তাদেরকে বর্জন করি।
প্রাপ্ত তথ্যের উৎসের প্রতি কৃতজ্ঞতা রইল।
লেখকঃ মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, গবেষক ও কলামিস্ট।