আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী । ১৯ জুলাই ২০১২। অন্য ৮-১০টি দিনের মতোই সাধারণ একটি দিন ছিল। আচমকা সংবাদ এলো গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না আজম্ম অভিমানে ছেড়েছেন চেনা আঙিনা। পাড়ি জমিয়েছেন অচেনা দিগন্তে। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ। আকাশে তখন সীমাহীন শূন্যতা। চারদিকে হাহাকার ধ্বনি। নীল নীল বেদনার ধূলি জমে নিশ্চুপ ক্লান্তিহীন। নিন্দুকের মুখেও তখন অতৃপ্তির আহ্লাদ। বর্ণচোরা অনুভূতির আবাদে বইয়ের পাতা থেকে একে একে বেরিয়ে আসে কল্পনার চরিত্ররা। এমনই কল্পনায় ভেসে বেড়ানো আমাদের হুমায়ুন আহমেদ।
কথাসাহিত্যের বিপুল ভাঁড়ার হুমায়ূন আহমেদ রেখে গেছেন আমাদের জন্য—যার দিকে তাকালে বিস্মিত হতে হয়। বিস্মিত এই জন্যে না যে, তিনি প্রচুর লিখেছেন। বিস্মিত এজন্যেই যে, তার প্রতিটি লেখাই পঠিত। বিপুলভাবে পঠিত। হুমায়ূন নিজেও বলতেন, মরার পর তাঁর লেখার কী হবে, এই নিয়ে তিনি ভাবিত নন। তাঁর সব লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পারছেন, এতেই তাঁর আনন্দ।
যদিও হুমায়ূন আহমেদের নামের পাশে প্রশংসার পাশাপাশি নিন্দাও জুটেছে বিস্তর। কিন্তু সুখের কথা এই যে, নিন্দামন্দ জীবিতাবস্থায় তাঁর কলমের গতিকে স্থিমিত করতে পারেনি। মাঝে মাঝে ভাবি, কী এমন জাদু আছে তাঁর লেখার মধ্যে, যার জন্যে তার সামান্য বিষয়ে লেখাও অসামান্য লেগেছে পাঠকের কাছে। অথবা অন্যভাবে বলা যায়, কেন বারবার হুমায়ূন পড়ি? একই লেখা বহুবার পড়লেও কেন প্রথম পাঠের মতোই মুগ্ধ করে?
হুমায়ুন সাহিত্য, গল্প ও উপন্যাস, গান এবং চলচ্চিত্র সবকিছুই রসবোধে ভরপুর। সবার মনের অবস্থা ভেবে মুখ খুললেন তিনি। বললেন, গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না চলে গেছে, এ জন্য আমাদের সবার মন খারাপ, সেটা আমি জানি। কিন্তু তার আজীবন থাকার কথা ছিল না। এটাও সত্যি। তিনি চলে গেছেন ঠিক। কিন্তু হিমু তোমাকে তো নিয়ে যাননি। কই রূপা তোমাকে নিয়ে গেছে? শুভ্র তুমিও তো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। তোমাদের কারও তো বয়স বাড়েনি। বাড়েনি আমার বয়সও। এরপরও কীসের অস্তিত্ব সংকটে সন্ত্রস্ত তোমরা? তিনি আসলে আমাদের ছেড়ে যাননি। তিনি আমাদের মাঝেই ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। এই যে হিমু, তুমি যখন হলুদ পাঞ্জাবি পরে জ্যোৎস্না দেখতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা পাকাবে, তখন তিনি আড়ালে দাঁড়িয়ে হাসবেন। রূপা, তুমি যখন হিমুর জন্য অপেক্ষা করবে, তখন দেখবে ঠিক তিনি তোমার পাশে সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়ে। আর শুভ্র চশমাটা খুলে চোখ বন্ধ করে একবার অনুভব কর তো কী দেখতে পাও? তিনি কি আছেন? না, অবশ্যই আছেন তিনি আমাদেরই মাঝে বেঁচে থাকবেন আজ, কাল, পরশু। যুগ থেকে যুগান্তর কাল থেকে কালান্তর।
কলম জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন ছয় বছর হয়ে গেছে। কিন্তু সত্যি কি চলে যেতে পেরেছেন তিনি? মোটেও না। তিনি কেবল তার শরীর ত্যাগ করেছেন। মানুষের অমরত্ব তার বয়সে নয়, কর্মে। হুুমায়ূন আহমেদ তার শরীর ত্যাগ করেছেন বটে, কিন্তু রেখে গেছেন তার অবারিত কর্ম। তার উপন্যাস, গল্প, নাটক, চলচ্চিত্র কিংবা গানগুলো তার সঙ্গে যায়নি। তার সৃষ্টির বিশালত্বের কাছে আগেই হার মেনেছে ব্যক্তি হুুমায়ূনের দোষ-ত্র“টি। বাংলা সাহিত্যে রস, আনন্দ আর উপভোগের যে আধুনিক ধারা, তার পথিকৃৎ হুমায়ূন আহমেদ। তিনি সংসার ত্যাগ করে আকাশচারী হয়েছেন। কিন্তু তার সৃষ্টি বেঁচে থাকবে আজীবন। সাহিত্যের নতুন যে ধারা তিনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন সেই পথে হাঁটছে বা হাঁটার চেষ্টা করবে তারই অনুজ সাহিত্যিকরা।
খন্ড খন্ড নীলের প্রবেধ ডিঙিয়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরে কোত্থেকে যেন এগিয়ে আসে হিমু। আবেগ তাকে ছোঁয় না কখনই। সব আবেগের ঊর্ধ্বে সে। মনের আনন্দে যখন যেটা ইচ্ছা করে, সেটাই করে বেড়ায়। নিয়ম-অনিয়মের ধার ধারে না। নিজের মতো নিজের পৃথিবী সাজানোই তার কাজ। এরপরও সেদিন ঔদাসীন্য গ্রাস করেছিল হিমুকে। নেমে পড়েছিল রাস্তায়। তবে গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার শবযাত্রায় শামিল হতে পথে নামেনি সে। তবে কেন নেমেছে? তখন উত্তরের যুক্তি খুঁজতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন মিসির আলী। কোনো কিছুই তাকে বিব্রত করে না।
হুমায়ূন আহমেদ দুইটা কারণে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন যে কারণে….
এক. দিল্লি এয়ারপোর্টে ডক্টর আনিসুজ্জামানকে দেখে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘ আপনে তো আর লেহাপড়া করলেন না।’ এই উক্তিটা শুধু আনিসুজ্জামান না, সমগ্র বাংলাদেশবাসীর জন্য সত্যি — আমরা পড়াশোনা করি না৷ বইয়ের গুণগত মান এবং সাহিত্যকর্মের বিবেচনায় যত খারাপ মানের বই হোক না কেন হুমায়ূন আহমেদ এই দেশের মানুষকে পড়তে শিখিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ তরুণকে টেক্সট বুকের বাইরের বই পড়া শিখিয়েছেন হুমায়ুন আহমেদ। ছবি তোলার জন্য হলেও এখন মানুষ টেবিলে কফির মগের পাশে একটা বই রাখে। এই কৃতিত্ব হুমায়ূন আহমেদের৷
দুই. বাংলাদেশের সাহিত্যের বাজার ছিল পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের দখলে। সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দুরা ঢাকায় বই বেঁচে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যেতেন। হুমায়ূন আহমেদ যতই বাজারি লেখক হন, হিমু যতই উন্মাদ হোক আর মিসির আলী যতই পাগলা হোক এদেরকে দিয়েই বাংলাদেশের বইয়ের বাজার থেকে ভারতীয়দেরকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছেন হুমায়ুন আহমেদ। সাহিত্য এবং অর্থনীতিতে তিনি জাতীয়তাবাদী নাগরিকের ভূমিকা রেখেছেন৷
আরেকটা কারণে মানুষ তাকে নিয়ে আজীবন আফসোস করবে। হুমায়ূন আহমেদ সৎ মানুষ ছিলেন। অকপটে স্বীকার করেছেন তিনি টাকার জন্য লিখতেন বেশীরভাগ সময়। অর্থাভাব ছিল তার সাহিত্যকর্মের অন্যতম অনুপ্রেরণা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত পারিবারিক প্রতিপত্তি থাকলে হুমায়ূন আহমেদ আরো অনেকগুলো মাস্টারপিস লিটারেচার রেখে যেতে পারতেন৷
হুমায়ূন আহমেদের গল্পগুলোতে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, মনোবিকলন, রিরংসা, সমকালীন সংকট, চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন, হতাশা উঠে এসেছে কখনো সরাসরি, কখনো রূপকের ছদ্মাবরণে। কিন্তু কোনো গল্পই পাঠকের মনে অভিঘাত সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয় না। এজন্যই সৈয়দ শামসুল হক কিংবা রমাপদ চৌধুরী মনে করতেন, বিশ্বের বিশটি ছোটগল্পের একটি লিস্ট করলে সেখানে হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প স্থান পাবে।
প্রয়াণ দিবসে গভীর শ্রদ্ধা।
লেখকঃ এপিএসনিউজ২৪.কম