নিজস্ব প্রতিবেদক
নানা অভিযোগে সিলগালা করে দেওয়া রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. শাহেদকে নিয়ে নিন্দার ঝড় ওঠার প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকে বলেছেন, বিষয়টি তাদের দলকে নতুন করে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে মো. শাহেদের অনেক ছবি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার হয়েছে এবং নানা আলোচনা চলছে। বছর অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্যে যুবলীগের কয়েকজন নেতার জড়িত থাকার অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মুখে আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনগুলোতে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেসব কী শুধু কথাতেই রয়ে গেছে, সেই প্রশ্ন আবারও সামনে এসেছে।
করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়াসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত সেই রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. শাহেদ নিজেকে আওয়ামী লীগে সম্পৃক্ত বলে দাবি করতেন। তার এমন দাবির মুখোমুখি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগেরই অনেক নেতা। আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপ-কমিটির একটি অনুষ্ঠানে মো. শাহেদ সেই কমিটির নেতাদের পাশে বসা আছেন, এমন একাধিক ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। এই উপ-কমিটির সদস্য সচিব ড. শাম্মী আহমেদ বলেছেন, মো. শাহেদকে তাদের কমিটিতে নেয়ার জন্য দলেরই অনেকে তদবিরও করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছেন যে, ছবি আছে, উনি আমাদের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। উনি নিজেকে আওয়ামী লীগের একজন বুদ্ধিজীবী বা ওই ধরনের একজন হিসেবে পরিচয় দিতেন। উনি আমার বাসায়ও এসেছেন, আমাকে অনেক অনুরোধ করেছেন যে, আপা আমাকে আপনার কমিটিতে রাখেন। আমি কমিটিতে রাখিনি।’ ড. শাম্মী আহমেদ আরও বলেন, ‘ওনাকে আমাদের উপ-কমিটিতে রাখার ব্যাপারে এমন কিছু জায়গা থেকে আমাকে বলাও হয়েছে যে, তুমি তাকে রাখ। অনেক সিনিয়ররা বলেছেন। আমি তাদের নাম বলব না। তারপরও আমি তাকে কমিটিতে রাখিনি।’ ‘আমাদের কমিটির অনুষ্ঠানের খবর কিভাবে পেতেন, তা জানি না। কিন্তু উনি অনুষ্ঠানে এসে হাজির হতেন। তবে আমি দায়িত্ব নিয়েই বলছি, উনি আমার উপ-কমিটির কোনো সদস্য ছিলেন না।’ তবে মো. শাহেদের কর্মকান্ড আওয়ামী লীগকে আবারও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে বলে দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অনেকে মনে করেন। কয়েকটি জেলা থেকে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী বলেছেন, এর আগেও বেশ কিছু ঘটনায় তাদের দল বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিল।
গত ফেব্রম্নয়ারি মাসেই অসামাজিক নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে যুব মহিলা লীগের একজন নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগে যুবলীগ এবং কৃষক লীগের বেশ কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হন। সেই পরিস্থিতিও আওয়ামী লীগকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছিল। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে আওয়ামী লীগের একজন নেত্রী জিনাত সোহানা চৌধুরী বলেছেন, এখন মো. শাহেদের ঘটনার প্রেক্ষাপটে মাঠপর্যায়ে তারা আবার প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন। শাহেদের মতো যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দল থেকে সুবিধা নিয়ে এসেছে, একটা দলকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে এদের এক বিন্দুও দ্বিধাবোধ বা সময় লাগবে না। এ ধরনের মানুষ যখন একটা বড় দলের নাম বিক্রি করে বা নামের ছত্রছায়ায় যখন এদের কর্মকান্ড চালায়, অবশ্যই সেটা আমাদের বিব্রত করে।
মাঠ পর্যায়ে যখন কাজ করতে যাই, আমাদের অবশ্যই এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তিনি আরও বলেন, ‘দলে শুদ্ধি অভিযানের যে বিষয়, আসলে প্রধানমন্ত্রী যে কাজগুলো হাতে নিয়েছেন, আমরা দেখেছি যে, প্রতি ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত কিন্তু প্রধানমন্ত্রী একাই লড়ে যাচ্ছেন এদের বিরুদ্ধে।’ আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় রয়েছে। দলটি লম্বা সময় ক্ষমতায় রয়েছে। দলটির নেতাদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে বলেছেন বিভিন্ন দল থেকে অনেকে সুবিধা নেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোতে ভিড়েছে। দলটির সিনিয়র নেতাদেরও অনেকে সেজন্য বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে বক্তব্য দিয়েছেন। গত বছর অবৈধ ক্যাসিনো বাণিজ্যে যুবলীগ, কৃষক লীগের কয়েকজন নেতা ধরা পড়ার পর দলে শুদ্ধি অভিযান চালানোর কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা কতটা হয়েছে, সেই প্রশ্ন তাদের দলের ভেতরেই উঠেছে।
দলটির একজন কেন্দ্রীয় নেত্রী মেহের আফরোজ বলেন, ‘যখনই আমরা এ ধরনের খবর পাচ্ছি, আমরা কিন্তু বসে নেই। আমরা পাপিয়াকে ধরি নাই? সব কিছু রিপোর্ট না আসলে বা সমস্যা চিহ্নিত হলে কিছু করা যায় না। কারণ হুট করে কাউকে চেনাটাও অনেক কঠিন ব্যাপার।’ আওয়ামী লীগের কিছু নেতার সঙ্গে শাহেদের ছবি যেমন ভাইরাল হয়েছে, তেমনি বিএনপির কিছু নেতার সঙ্গে তার পুরনো অনেক ছবি ফেসবুকে শেয়ার হয়েছে। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দলটির সিনিয়র নেতারা এখন দাবি করেছেন। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ফোরাম প্রেসিডিয়ামের সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, ‘এই ধরনের ঘটনায় যে কেউ বিব্রত হতে পারে এবং হওয়াটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে কথাটা সংসদে বলেছেন যে, এর প্রত্যেকটা ঘটনাই কিন্তু আওয়ামী লীগের সরকার এবং প্রশাসনের মাধ্যমে আইনগতভাবে উদঘাটিত হচ্ছে, অন্য কেউ এসে খবর দিয়ে যায় নাই।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘একটা সরকার ক্ষমতায় থাকলে নানাভাবে সেখানে অনুপ্রবেশ ঘটে। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, এটা সরকার পালাপোষা করছে নাকি এর মূল উৎপাটন করতে চাচ্ছে- সেটাই দেখার বিষয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।’ আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, তাদের দলের সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল হয়েছে গত ডিসেম্বরে। এরপর এ বছর করোনাভাইরাস মহামারির কারণে শুদ্ধি অভিযানসহ সাংগঠনিক কার্যক্রমের দিকে তারা সেভাবে নজর দিতে পারছেন না। বিবিসি বাংলা