বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে সাম্প্রতিক সময়ে মৃত্যুর হার বেড়েছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঝুঁকি, কাজের পরিবেশ, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা আর অনিয়মিত ঘুম-খাওয়ার কারণে নানা রোগে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অকাল মৃত্যু বাড়ছে বলে মনে করছেন বাহিনীটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পুলিশ হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
বাহিনীর সদস্যদের কর্মঘণ্টা কমানো ও কাজের পরিবেশ উন্নয়ন, উন্নত লজিস্টিক সাপোর্ট, চিকিৎসার পরিধি বাড়ানোর দাবি জানিয়ে তারা বলছেন, এতে রোগশোকের ঝুঁকি হ্রাসের পাশাপাশি পুলিশের সেবার মান বাড়বে।
জানা গেছে, নানা কারণে গত এক বছরে পুলিশের ৫৫০ জন সদস্য মারা গেছেন। এর মধ্যে কর্মরত অবস্থায় মারা যান ১৭৯ জন। অন্যদের মধ্যে অনেকের নানা রোগে ও স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
একই ধরনের তথ্য উঠে এসেছে মিরপুর পুলিশ স্টাফ কলেজে আয়োজিত ‘পুলিশ মেমোরিয়াল ডে ২০২০’ অনুষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বক্তব্যে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. জাবেদ পাটোয়ারী, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামাল, র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ডিএমপির কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, দেশকে সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গিমুক্ত রাখতে গিয়ে এবং পেশাজনিত নানা রোগে প্রতি বছর পুলিশ সদস্যদের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। কর্মঘণ্টা বেশি হওয়ার কারণে বিভিন্ন রোগে পুলিশের অনেক সদস্য মারা যান। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের কিলিং অ্যাকশনে অনেকে আহত হন বা মারা যান। গত বছর ৫৫০ সদস্যকে হারিয়েছে পুলিশ বাহিনী।
পুলিশ সব সময় দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করে জানিয়ে ড. জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘১৯৭১ সালে নয় মাস যুদ্ধ করে আমাদের প্রায় ১২০০ সদস্য জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাস দমন করতে গিয়ে আমাদের ১৯ জন নিহত এবং কয়েক শ সদস্য পঙ্গুত্ববরণ করেন। জঙ্গিবাদ রুখে দিতে গিয়ে নয়জন সদস্য জীবন বিসর্জন দিয়েছেন এবং অনেকে আহত হয়ে পঙ্গত্ববরণ করেছেন। এখনো দেশকে সন্ত্রাস, মাদক ও জঙ্গিমুক্ত নিরাপদ রাখতে পুলিশ কাজ করছে। পুলিশের প্রতিটি সদস্য পরম মমতায় তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।’
পুলিশে অনাকাক্সিক্ষত অকাল মৃত্যু কমানোর ওপর জোর দিয়ে র্যাবের ডিজি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, এখন পুলিশ বাহিনী বড় হয়েছে। সেই সঙ্গে মৃত্যুর মিছিলও বাড়ছে। যেকোনো সহকর্মীর অকালে মৃত্যুই অনাকাক্সিক্ষত। তার মৃত্যু শুধু মৃত্যু নয়, পরিবারের ওপর বিপর্যয়। এটা মেনে নেওয়া কষ্টের। বেনজীর বলেন, আগে ৩০-৪০ জন মারা যেত, তখন বাহিনী ছোট ছিল। এখন বাহিনী বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর মিছিলও বাড়ছে।
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঝুঁকি, কাজের পরিবেশ ও ঘুম-খাওয়া ঠিক না থাকায় পুলিশ বাহিনীতে অকাল মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে বলে মনে করেন র্যাবের মহাপরিচালক। তিনি বলেন, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাহিনীর সদস্যদের খাওয়ার ঠিক নেই, ঘুমের ঠিক নেই। কাজের পরিবেশের ঠিকই নেই। সব মিলিয়ে সব সময় বিপদগ্রস্ত থাকে পুলিশ সদস্যরা।
তবে আগের চেয়ে পুলিশে চিকিৎসাব্যবস্থার মান বেড়েছে জানিয়ে বেনজীর বলেন, ঢাকায় যে চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে তা তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে পুলিশ সদস্যদের স্বাস্থ্যঝুকি কিছুটা কমবে।
পুলিশে মৃত্যুর মিছিল কমাতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ‘তবে যেহেতু আমরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করি, আমাদের দায়িত্ব বা পেশাটাই এ রকম। ঝুঁকি নিতেই আমরা এই পেশায় আসি।’
পুলিশে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যঝুকি সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও নারায়ণগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ জায়েদুল আলম অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা হ্রাস ও জেলা পর্যায়ে পুলিশের চিকিৎসার পরিধি বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন।
কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় কিংবা সড়কে ডিউটি করার সময় দুর্ঘটনায় অনেক সদস্যের মৃত্যু হয়। এই দুই ক্ষেত্রে পুলিশে আরও যানবাহন বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক। বলেন, সরকার পুলিশের উন্নয়নের পাশাপাশি আধুনিকায়ন করতে চাচ্ছে। তার জন্য জনবল বাড়াতে হবে। তাহলে কর্মঘণ্টা হ্রাসের পাশাপাশি মৃত্যুঝুঁকিও কমবে।’
গত পুলিশ সপ্তাহে সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কী ধরনের দাবি করা হয়েছে জানতে চাইলে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদকা বলেন, ‘আগেও জানানো হয়েছে, এবারও আমরা গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছি। বার্ষিক ফলোআপ এবার দেখব। আশা করি এবার দাবি বাস্তবায়ন হবে।’
পুলিশে হাসপাতারের সংখ্যা বাড়ালে মৃত্যুর হার কমবে বলে মনে করেন এসপি মোহাম্মদ জায়েদুল আলম। তিনি বলেন, পুলিশের যে হাসপাতাল আছে, সেখানে আধুনিক যন্ত্রপাতি বেড়েছে। তবে তা এখনো অপর্যাপ্ত। বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরে পুলিশ হাসপাতাল করা গেলে অসুস্থ পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসা দ্রুত সময়ে সেখানে করা সম্ভব হবে। এতে মৃত্যুঝুঁকি কমবে।’
দেশের সড়কে পরিবেশদূষণ বিশেষ করে ট্রাফিক বা জেলা পুলিশের সদস্যদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বড় কারণ বলে ধরা হয়। সারা সময় ধুলাবালিতে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালনের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন পুলিশ সদস্যরা।
রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের একজন দায়িত্বশীল চিকিৎসা কর্মকর্তা জানান, এই হাসপাতালে যেসব পুলিশ সদস্য চিকিৎসার জন্য আসেন তাদের বেশির ভাগ ক্যান্সার, কিডনি ও হার্টের রোগে আক্রান্ত। রাস্তায় রাস্তায় ডিউটি করার কারণে তারা এসব রোগে আক্রান্ত হন। ৪০ বছরের বেশি বয়সী পুলিশের যেসব সদস্য আছেন তাদের এসব রোগ বেশি দেখা যায়।
খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম, রাস্তায় ডিউটি, ধুলাবালি, ঠিকমতো ঘুম-বিশ্রামের অভাবে পুলিশের সদস্যদের শরীরে নানা ধরনের অসুখ বাসা বাঁধছে বলে জানান তিনি।